সৌদি আরবে বাইডেনের ‘ইহুদিপ্যাকেজ’

।। রাকিবুল হাসান ।।

শুক্রবার, ১৫ই জুলাই, ঘড়িতে সন্ধ্যা ছয়টা ছুঁইছুঁই। জেদ্দার মাটি স্পর্শ করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বহনকারী বিমানটি, যা সরাসরি উড়ে এসেছে ইজরাইলের রাজধানী তেল আবিব থেকে। এ এক ‘ঐতিহাসিক’ ক্ষণ! নিঃসঙ্গ ফিলিস্তিন আর মসজিদুল আকসার সঙ্গে প্রতারণার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকই বটে!

নির্বাচনী প্রচারণাকালে বাইডেন তার পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ার অভিযোগ তুলেন। ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি ছিল খোলামেলা ‘রিয়েলপলিটিক’। রিয়েলপলিটিক বলা হয় মতাদর্শকে পাশে ফেলে বাস্তবতার আলোকে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা। যেমন ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে ইজরাইলের স্বার্থরক্ষার জন্য যা যা করা দরকার করেছেন। গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালারাষ্ট্র হয়েও তথাকার স্বৈরশাসকদের সাথে কাজ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি।

অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি গৃহীত হয়েছে রিয়েলপলিটিক অনুযায়ী। এক্ষেত্রে ট্রাম্প-বাইডেনের পার্থক্য হচ্ছে একজন বাচাল, আরেকজন মুখচোরা। সবসময় এমনই হয়ে আসছে।

তো, গণতন্ত্র উদ্ধারে ব্রত বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিল গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদিকে একঘরে করে ফেলা হবে। যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানকে তিনি ‘বসিয়ে’ দিবেন! কিন্তু সব জারিজুরি উল্টে যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। তেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠার পর গ্যাসের উপর চাপ পড়ে। সেই চাপ কমাতে যুক্তরাষ্ট্র তেল-উৎপাদনকারী দেশগুলোকে তেলের সরবরাহ বাড়াতে অনুরোধ করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক তেলের সরবরাহ বৃদ্ধিতে সম্মত হয়নি। গণতন্ত্র আর মানবাধিকার ইস্যুতে সৌদিকে টাইট দিতে চাওয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সালমানও একটু পাল্টা ‘টাইট’ দিতে মনস্থ করে।

একঘরে করতে চাওয়া দেশে নিজেই ছুটে যান খোদ বাইডেন। বাইডেনের সফর নিশ্চিত হওয়ার পর অবশ্য ওপেক ‘সীমিত’ পরিসরে তেল উৎপাদন বাড়াতে সম্মত হয়। বলাই বাহুল্য- তা হয়েছে সৌদির ইচ্ছায়।

যেসব উদ্দেশ্যে বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়েছেন, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইজরাইলের সাথে আরবরাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে  যাওয়া।  ট্রাম্পের  প্রস্তাবিত  তথাকথিত আব্রাহাম এ্যাকর্ডে যুক্ত আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান। ইজরাইলের সাথে তারা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, ইজরাইলকে স্বীকৃতিপ্রদান, বাণিজ্য বৃদ্ধি, কিংবা সোজা কথায় আরববিশ্ব থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুকে গায়েব করে দেয়াই এ্যাকর্ডের প্রধান উদ্দেশ্য।

উল্লেখ্য অসলো শান্তি চুক্তিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের কথা বলা হয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিষয়টা পাশ কাটিয়েই সবাই ইজরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করুক, একে আরববিশ্বের অংশ হিশেবে মেনে নিক। মধ্যপ্রাচ্য সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন দৃশ্যপটের কোথাও নেই। সৌদি যদিও এখনো সম্পর্ক স্বাভাবিক করেনি, তবে ইজরাইলের সাথে বাহরাইনের সম্পর্ক কোন অবস্থাতেই সৌদির সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয়।

বাহরাইন বাহ্যত স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও, এখনো পর্যন্ত বাস্তবে একে সৌদির প্রদেশ হিশেবেই দেখা হয়। বিশেষত আরব বসন্তের সময় বাহরাইনের বর্তমান রাজপরিবারকে জনরোষ থেকে রক্ষা করেছে সৌদি আরব। সরাসরি সৌদি সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। ফলে ইজরাইলের সাথে বাহরাইনের সম্পর্ককে দেখা হচ্ছে মূলত সৌদির ‘আন-অফিশিয়াল’ সম্পর্ক হিশেবে। তাছাড়া বাদশাহ সালমান যতদিন জীবিত আছেন, ততদিন তিনি তার রাজনৈতিক মত থেকে হটবেন না। তার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেই কেবল ইজরাইলের সাথে আলাপ। তার আগে নয়।

তাই সব পক্ষই এখন বয়োবৃদ্ধ বাদশাহর মৃত্যুপরবর্তী সময়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পথ সুগম করা হচ্ছে।

তিরান ও সানাফির নামক দুটি দ্বীপ সৌদির নিকট হস্তান্তরে সম্মত হওয়ার মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালে মিশর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। নীতিগতভাবে প্রেসিডেন্ট সিসি দ্বীপ দুটি সৌদির হাতে তুলে দিতে সম্মত হন। বাস্তবে এগুলো সৌদি আরবের ভূখ-ই ছিল। ১৯৫০ সালে সৌদি এগুলো মিশরের হাতে তুলে দেয়।

কারণ, তখন আরববিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ছিল মিশর। ইজরাইলের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে মিশরই পারে দ্বীপ দুটিকে রক্ষা করতে। এগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, লোহিত সাগর থেকে উত্তর দিকে দুটি প্রণালী ঢুকেছে। একটি মিশরের সিনাই উপত্যকার পশ্চিম অংশ দিয়ে, যা সুয়েজ প্রণালী নামে পরিচিত। সুয়েজ খাল হয়ে যা ভূমধ্যসাগরের সাথে মিশেছে।

আরও পড়তে পারেন-

দ্বিতীয় প্রণালিটি হচ্ছে স্ট্রেইট অব আকাবা বা আকাবা প্রণালী। এটি ঢুকেছে মিশরের সিনাই উপত্যকার পূর্বাংশ আর সৌদির মাঝখান দিয়ে। আবার এই  প্রণালির  শেষমাথায় হচ্ছে ইজরাইলের ইলাত (আরবিতে যেটাকে আমরা পড়েছি ইলাহ বা আইলাহ নগরি) সমুদ্রবন্দর অবস্থিত। এখানে আকাবা নগরিও অবস্থিত। এই কারণেই একে আকাবা প্রণালী বলা হয়। আর এই প্রণালির একদম প্রবেশপথেই রয়েছে তিরান ও সানাফির দ্বীপদুটি। এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে লোহিত সাগরে ইজরাইলের প্রবেশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ইলাত থেকে আকাবা প্রণালী হয়ে সাগরে নামা। সাগরমোহনায় আছে দ্বীপদুটি। ফলে এগুলো তিন দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিশর, সৌদি ও ইজরাইল।

কিন্তু মিশর দ্বীপদুটি রক্ষা করতে পারেনি। ইজরাইল জানত এটি তাদের অস্তিত্বের অংশ। ইজরাইলকে টিকে থাকতে হলে এই দ্বীপ দুটি তার চাইই। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে সিনাই উপত্যকার পাশাপাশি উপত্যকাসংলগ্ন দ্বীপ দুটিও ইজরাইল দখল করে নেয়। দুইবছর পর ১৯৭৯ সালে শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ইজরাইল এগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীদের’ (মূলত যুক্তরাষ্ট্রের) হাতে তুলে দেয়। তখন থেকে এগুলো যুক্তরাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে।

তো, ২০১৬ সালে সিসি দ্বীপগুলোকে সৌদির হাতে তুলে দিতে সম্মত হলেও, দেয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। কারণ, তা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীদের ‘দখলে’। এবারের দরকষাকষিতে তাই সৌদি দ্বীপদুটিকে ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ এগুলো থেকে শান্তিরক্ষী বা যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী সরিয়ে নিয়ে সৌদির হাতে তুলে দিতে হবে। তেলের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র শুধু দ্বীপ কেন, বিন সালমানের পা চাটতেও রাজি। কিন্তু সমস্যা বাঁধে অন্যত্র। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী এই দ্বীপের আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর যেকোন রদবদল করতে হলে সম্মতি লাগবে ইজরাইলের!

অর্থাৎ সৌদি আরব ১৯৫০ সালে মিশরকে দেয়া নিজ ভূখণ্ড ফেরত নিতে চাইলে ইজরাইলের অনুমতি লাগবে, যাদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্যই এগুলো মিশরের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল! বিশ্বরাজনীতির কী বিপুল পট পরিবর্তন। তবে ইজরাইল সম্মতি দিয়েছে! বিনিময়ে সৌদির আকাশপথ সব ধরনের ইজরাইলি বিমানের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে! যা দুইদেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। এতদিন যা হয়েছে লুকিয়ে-ছাপিয়ে।

বাইডেন সৌদিতে পা রাখার আগের দিন ১৪ই জুলাই বিকেলে সৌদি আরব ইজরাইলি বিমানের জন্য নিজের আকাশপথ উন্মুক্ত করে দেয়। সেই উন্মুক্ত পথে, ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট সরাসরি তেল আবিব থেকে জেদ্দায় অবতরণ করেন! ‘দ্বীপরাজনীতি’ ছাড়াও আরও কিছু ফ্যাক্টর ছিল। যেমন, সৌদিতে পা রাখার আগে বাইডেন ইজরাইলের অত্যাধুনিক আকাশপ্রতিরক্ষাব্যবস্থা পরিদর্শন করেন। হুতিদের মিসাইল আর ড্রোন আক্রমণের শিকার সৌদির জন্য যা বড্ড প্রয়োজন। কিন্তু ইজরাইলের সাথে ব্যবসা করতে হলে তো আগে তাদেরকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

পাশাপাশি ইজরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইজরাইলের তো বটেই, ইজরাইলের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন যেকোন দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন মাফ। মানবাধিকার ইস্যুতে চাপের মুখে থাকা সৌদির জন্য যা অতীব লোভনীয়। ইতঃপূর্বে খোদ মার্কিন নাগরিকদের উপর ইজরাইলের চালানো বর্বরতাগুলোও যুক্তরাষ্ট্র মুখ চেপে গেছে। এমনকি সাম্প্রতিক পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন তোলা ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনায়ও যুক্তরাষ্ট্র ইজরাইলকে দায়মুক্তি দিয়েছে! অবশ্য বিশ্বমিডিয়ায় এটি ফলাও হয়নি। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে তার হত্যাকা-কে অনিচ্ছাকৃত ভুল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, আকলেহ শুধু ফিলিস্তিনি নাগরিক নন, তার মার্কিন নাগরিকত্বও ছিল!

দ্বীপের সাথে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে। ভবিষ্যতে আরও ‘বিষয়’ আসবে, আর একটু একটু করে ফিকে হতে থাকবে মসজিদুল আকসা, পরিত্যাজ্য হতে থাকবে ফিলিস্তিন। আর আরব রাষ্ট্রগুলো সবেগে ধেয়ে যেতে থাকবে আপন ধ্বংসপানে।

লেখক: তাকমিল, মাদরাসা বাইতুল উলুম, ঢালকানগর, শিক্ষার্থী; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।