।। মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ওমর ।।
অবশেষে চিরদিনের জন্য আমাদেরকে বিদায় জানালেন উস্তাযে মুহতারাম, দারুল উলূম দেওবন্দের নায়েবে মুহতামিম মাওলানা আবদুল খালেক সাম্ভলী রহ.। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
হযরতের অসুস্থতার খবর অনেকদিন যাবত অন্তর্জালে পাচ্ছিলাম। মাঝেমধ্যে সুস্থতার সংবাদ শুনে কিছু আশান্বিত হতাম। কিন্তু ইন্তিকালের দিন বাদ মাগরিব মোবাইলের স্ক্রীন চালু করতেই সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া হযরতের ইনতেকালের সংবাদটা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
গত এক বছরে উলামায়ে কেরামের বিদায়ী মিছিল এত দীর্ঘ হবে, এটা অবুঝ মনকে কোনোভাবেই সান্তনা দিতে পারছি না। কিন্তু তাকদীরের সামনে মাখলুক অসহায়। মন না চাইলেও মেনে নিতে হয়।
— দারুল উলূম দেওবন্দে হযরতের কাছে সুনান ইবনে মাজাহ শরীফ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। শিক্ষা বর্ষের শুরুর প্রথম তিন মাস ইশার পর হযরত আমাদেরকে সবক পড়াতেন। মিষ্টি ভাষা এবং মিষ্টি হাসির মায়াবি মুখ নিয়ে প্রতিদিন ক্লাসে উপস্থিত হতেন। প্রত্যেক মৌসুমে চলার পথে হযরত সব সময় মাথা এবং মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে থাকতেন। আরবীয় ধাঁচে। শীত কিংবা গরম কোনো সময় এতে ব্যতয় ঘটতো না। এত নরম এবং মৃদু পায়ে হাটতেন, আশেপাশের কেউ অনুভব কারাটাও কঠিন হয়ে পড়ত। দরসে এসে প্রথমেই ছাত্রদের দিয়ে হাদীসের ইবারত পাড়াতেন। এর পর নিজস্ব আন্দাজে প্রতিটি শব্দের ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন। হযরতের আরবী এবং উর্দু ভাষার উচ্চারণ এত মিষ্টি, এত স্পষ্ট এবং এতই সাহিত্যপূর্ণ ছিল যে, আমরা পুরাই মাবহুত হয়ে যেতাম, বৃদ্ধ মানুষ কীভাবে এত সুন্দর কথা বলতে পারে!!!
আরও পড়তে পারেন-
- মুসলমানদের জন্য রোগ-ব্যাধিতে চিকিৎসা করানো সুন্নাত
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- মাহে মুহাররম ও আশূরা: করণীয় ও বর্জনীয় আমলসমূহ
হযরতের আখলাক, মু’আমালা, চলাফেরা সবকিছুই ছিল অসাধারণ। নববী আদর্শের উজ্বল নমুনা। মানুষ যে মাটির তৈরি এটা সহজেই বুঝে আসত যখন হযরতকে কাছ থেকে দেখতাম। আমার মনে পড়ছে না, পুরো বছর হযরত কোনো সময় কাওকে ধমক দিয়েছেন কিংবা রাগ করে কথা বলেছেন। দরসে কিংবা দফতরে অথবা বাসায়। সব সময় যে কোনো বিষয়কে তিনি হাসিমুখে সহ্য করতেন, খুশিমনে গ্রহণ করে নিতেন।
— দারুল উলূমে হযরতের জন্য যে নির্ধারিত কোয়ার্টার ছিল, তার সামনের সবুজ গালিচা ওয়ালা মাঠে আসরের পর হযরত পায়চারি করতেন। একদিন সাহস এবং ভয়কে সঙ্গ করে আসরের পর হযরতের সামনে উপস্থিত হয়ে সালাম আরয করলাম। শুরুতেই এক চিলতে হাসির ঝিলিক দিয়ে আমার সব ভয় নিমিষেই দূর করে দিলেন। এরপর দীর্ঘ পনের বিশ মিনিট পর্যন্ত হযরতের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল। এর কয়েকদিন আগে হযরত বাংলাদেশ সফর শেষ করে এসেছিলেন। সেই সফরে হযরত দারুল হাটহাজারীতেও তাশরীফ রেখেছিলেন। বাদ মাগরীব দারুল হাদীসে ছাত্রদের সামনে বয়ানও করেছেন। আমার ওয়ালীদে মুহতারাম সেসময় হযরতের সাথে সাক্ষাত এবং আলাপও করেছিলেন। সেদিন হাটহাজারী এবং বাংলাদেশ বিষয় নিয়ে প্রায় ১৫/২৯ মিনিট পর্যন্ত কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। বিদায় নেয়ার সময় হযরত বলেছিলেন, ” মিলতে র্যাহ না”। আমি “জ্বী হযরত, দু’আ কি দরখাস্ত” বলে চলে আসলাম। কিন্তু আফসোস! এরপর আরো বিভিন্ন সময় হযরতের সাথে ব্যাপাকভাবে সাক্ষাত হলেও, বিশেষভাবে “মিলতে র্যাহ না” র সুযোগ আর আসেনি। এবং আজ হযরত চিরস্থায়ী জীবনের বাসিন্দা হয়ে গেলেন।
—দারুল উলূম দেওবন্দে হযরত হাদীস এবং আদবের তাদরীসের পাশাপাশি নায়েবে মুহতামিমের দায়িত্বেও ছিলেন। ছিলেন আমনত এবং দিয়ানতের জ্বলন্ত নিদর্শন ছিলেন।
হযরতের দরসগুলো এখনো কানে বাজে। মিষ্টি মিষ্টি, নরম নরম ভাষা। হাদীসের প্রতিটি শব্দ নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা করতেন। দরসের ফাঁকে তালিবুল ইলমদেরকে ইলমি লাতীফাও বলতেন। মাঝেমধ্যে আলোচনার ইবারতগুলো টেনে সবাইকে হাসাতেন। ইবনে মাজার বাবুল ইতিসাম বিসসুন্নাহ পড়াতে গিয়ে প্রায় সময় কবর পূজারীদের উদাহরণ দিয়ে বলতেন, “কবরিয়ুঁ নে ইয়ে করতা হ্যাঁয়। ইয়ে ক্যাহ তা হায়।”
—দীর্ঘদিন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ১৯ যিলহজ ১৪৪২ হিজরী জুমাবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তিনি রফীকে আ’লার ডাকে সাড়া দেন। আল্লাহ উস্তাযে মুহতারামকে রহমতের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখুন, ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন, রফয়ে দারজাত করুন। পরিবারসহ সবাইকে সবরে জামীল দান করুন। আমীন।
- মাওলানা ইসহাক ওমর (হাফি.), ফারেগ- দারুল উলূম দেওবন্দ, শিক্ষক- দারুল উলূম হাটহাজারী, সহকারী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম।
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/