স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহারে পরিমিতিবোধ ও দায়িত্বশীল হতে হবে

।। আবুল বাশার (বাবু) ।।

ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপক প্রসার এবং স্মার্টফোনের দৈনন্দিন উন্নতি ও সহজলভ্য হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়া বর্তমানে পারস্পরিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বেশি দিন আগের কথা নয়, মাত্র দেড় যুগ আগেও দূর-দুরান্তের কষ্টসাধ্য পথ পাড়ি দিয়ে হলেও মানুষ একে অন্যকে দেখতে আসতো।

এতে মেহমান-মেযবান উভয়ের চোখে-মুখে ও মনে এক অন্যরকম আনন্দ ও সুখের হিল্লোল বয়ে যেতো। মায়া-মমতা, হৃদ্যতা, স্নেহ ও শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালবাসার প্রকাশ পরস্পর চাক্ষুষ ও হৃদয় দিয়ে তাজা অনুভব করতো। এতে হৃদয় ও মনের টান মযবুত হতো। পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় হতো। একে অপরের জন্য ত্যাগের মানসিকতা গড়ে ওঠতো।

আগে পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের দাওয়াত পৌঁছাতেও যেতে হতো অনেক পথ পাড়ি দিয়ে। এতে দাওয়াতের আবেদন যেমন গুরুত্ববহ হতো, তেমনি দাওয়াত রক্ষার দায়ও গভীর হতো। ফলে পারিবারিক, সামাজিক ও আত্মীয়তার বন্ধন মজবুত হতে সহায়ক হতো। তেমনি দাওয়াত রক্ষা ও আতিথেয়েতা থেকে গল্প, আড্ডা, খুনসুটি, মেলবন্ধন ছিল স্বাভাবিক চিত্র।

আর্থিক সংগতি না থাকলেও আন্তরিক বন্ধন ছিল অটুট। আর এখন একটি ফোন কল বা ম্যাসাঞ্জারের মাধ্যমে এক মুহূর্তেই কাজ শেষ। ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক বা হৃদ্যতা, চোখ ও মনের যে তাজা অনুভব, তা আগের মতো আর থাকছে না। বিয়ে-শাদি বা বিভিন্ন দাওয়াতও এখন মানুষ সামান্য ম্যাসেজের মাধ্যমে বা ফেসবুক টুইটারের মাধ্যমে দিয়ে দিচ্ছে। যে কারণে এসব পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান ও আয়োজনগুলো আগের মতো আবেদন ও সাড়া জাগায় না। দিন দিন এসব পারিবারক ও সামাজিক অনুষ্ঠান নিছক প্রথা পালনে রূপ নিচ্ছে।

একসময় পরিবারের সবাই মিলে এক সঙ্গে বসে প্রাণবন্ত আড্ডা ও গল্পের আসর হতো। আর শিশুরাও এসব বৈঠক ও আসর থেকে অনেক কিছু শিখতে পারতো। আনন্দ করতো। বড়দের পারিবারিক ও সামাজিক আচরণগুলো দেখতে দেখতে শিশু-কিশোরদের মনে গেঁথে যেতো। এতে বড়-ছোট, বয়স্ক-শিশু-কিশোরদের মাঝে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা ও সামাজিক আচরণ অনুশীলনের সুযোগ তৈরি হতো। অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হতো। স্নেহ-মমতা-ভালবাসা-মানবিক টান বৃদ্ধি পেতো।

আরও পড়তে পারেন-

আর এখন স্যোশাল মিডিয়ায় যুক্ত হয়ে সবাই নিজেদেরকে এক কাল্পনিক জগতে ডুবিয়ে রেখেছে। দেখা যায়, সামনা সামনি পারস্পরিক আলাপেও একে অন্যের প্রতি শতভাগ মনোযোগ দিতে পারছে না। ঘন ঘন মোবাইল ফোন চেক করছে। কাউকে টুকিটাকি মেসেজ দিচ্ছে। অথবা লাইক-কমেন্ট করছে আলাপের ফাঁকে ফাঁকে। এমনও দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে বার বার ফোন কল আসছে, রিসিভ করছে। এতে অন্যপক্ষ মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে, আলোচনায় মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। শতভাগ মনোযোগ না পাওয়ায় অন্যপক্ষও এতে বিরক্ত বা হতাশ হচ্ছে। ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও পারিবারিক বন্ধনও দিনে দিনে শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

পরিবারে একে অন্যের প্রতি ভালোবাসার যে টান, সেটার পরিবর্তে বাড়ছে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি আসক্তি। পরিবারের সদস্যরা একে অপরের শারীরিকভাবে কাছাকাছি অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও মনের দিক থেকে দেখা যায়, নানা জায়গায় নানাজনের সাথে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। চার দেওয়ালের ভেতরে থাকা পরিবারের মানুষগুলোর সম্পর্কও যেন দিন দিন যান্ত্রিকতার মতো হয়ে যাচ্ছে। হাই, হ্যালো যেন যাস্ট সৌজন্যতা রক্ষা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতবিনিময় কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু এবং বৃদ্ধরা।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে বিয়ে ভাঙ্গার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্যোশাল মিডিয়া বা ফেসবুক। দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙ্গার হার আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের ভালবাসা-ভাললাগার আলোচনার চেয়েও ফেসবুক ফ্রেন্ডদের নিয়ে আলোচনা করছে বেশি। এতে মনের অগোচরে পরস্পরের প্রতি বিরক্ত, অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা তৈরি হচ্ছে। ফলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের আবেদন গভীরতা হারাচ্ছে, ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে।

সমাজ বিজ্ঞানীদের অনেকে এ জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকেই দায়ী করছেন বেশি। এতে পারস্পরিক সম্পর্কে যেমন হৃদত্যতা কমে যাচ্ছে, তেমনি ঘরোয়া সম্পর্ককে যাস্ট প্রয়োজন রক্ষার মতো চরম আত্মকেন্দ্রিকতায় নিয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরিচিত যে কারো সাথে সহজ যোগাযোগের সুযোগ থাকায় দাম্পত্য সম্পর্কে বাড়ছে সন্দেহ ও অবিশ্বাস এবং কমছে শ্রদ্ধাবোধ।

স্যোশাল মিডিয়ার ভয়াবহতা থেকে কীভাবে আমরা বের হয়ে আসতে পারি? এমন প্রশ্নে কোন কোন সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরকে সে আলোকে তৈরি করে নিতে হবে। প্রযুক্তিকে বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু দেখতে হবে আমি সেটাকে কীভাবে ব্যবহার করছি। আমাদের সন্তানদেরকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। স্যোশাল মিডিয়ার প্রভাব অনেক বেশি। এ থেকে নিজেদেরকেই বের হয়ে আসতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।

অনেকেই বলে থাকেন, এই সঙ্কট কাটাতে হলে ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে উৎখাত বা স্থায়ীভাবে বন্ধের বিকল্প কিছু নেই। কিন্তু আসলেই কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে এখন আর স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব? তবে এর ব্যবহারকে সীমিত করা যায়। এ জন্য নিজেদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। সন্তানদের কাছ থেকে কোনো কিছু লুকাতে চাইলে তারা আরও বেশি পরিমাণে সেদিকে ঝুঁকবে। তাদেরকে ভালো মন্দ, কোনটা সঠিক সে বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতার পাঠ ও অনুশীলনে অভ্যস্ত করে গড়ে তুলতে হবে। পারিবারিক বন্ধন ঠিক রাখতে পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করতে হবে। সুতরাং নতুন নতুন প্রযুক্তি আসবে কিন্তু সেটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। সন্তানরা তার অপব্যবহার করছে কিনা, বা প্রযুক্তি ব্যবহারের সময় হওয়ার আগেই তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে কিনা, সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব।

তবে এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষ অনেক বেশি জড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে কিশোর-যুবারা, এমনকি অনেক বয়স্করাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে হারে সময় ব্যয় করেন, উন্নত বিশ্বে এমন লাগামহীন সময় ব্যয় করতে দেখা যায় না। এর মানে আমাদের দেশের নাগরিকদের বড় একটা অংশ ইতিমধ্যেই ইন্টারনেট আসক্তিতে ভুগতে শুরু করেছেন। এতে করে সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। সবকিছু যান্ত্রিক নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। পারস্পরিক আত্মিক সম্পর্কও নষ্ট হচ্ছে।

এক সময় পারিবারিক বন্ধন, খুনসুটি, পারস্পরিক আন্তরিকতা, আড্ডা ছিল আমাদের সমাজের অন্যতম সংস্কৃতি। আর এখন পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্ক ইন্টারনেট নির্ভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমমুখী হয়ে উঠেছে। আধুনিক হতে গিয়ে সবকিছু যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এদেশে মানুষের আন্তরিকতা বা পারিবারিক বন্ধন নিয়ে যে সুনাম ছিল, সেটা এখন অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে।

মানুষের সম্পর্কের মধ্যে যে মধুরতা থাকার কথা, সেটা নষ্ট করে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ। নেশার মতো স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকে সব পেশার মানুষ এখন এ নেশায় আসক্ত। সকাল বিকাল রাত সব সময়ই ফেসবুক, টুইটার, গেমসে আসক্ত হয়ে আছে কিশোর তরুণ ও যুবা-পৌঢ়রা। দিন দিন আশংকাজনক হারে শিশুরাও যুক্ত হচ্ছে। এ সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে।

এ জন্য অভিভাবকদেরকে যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং সরকারকেও এ বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। অন্যথায় আত্মকেন্দ্রিকতার ভয়াল গ্রাস আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে তছনছ করে দিতে দেরি হবে না। এর কুফল দিন দিন পরিবার, সমাজ ও দেশকে গ্রাস করে ছাড়বে।

মেহেরবান আল্লাহ আমাদের সকলকে সহীহ বুঝ দান করুন এবং প্রত্যেককে স্ব স্ব ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও দ্বীনি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ যথাযথভাবে আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।