হযরত মূসা (আ.) আল্লাহর মনোনীত বিশেষ নবী ও রাসূল

।। আল্লামা মুফতি জসীমুদ্দীন ।।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা মারইয়ামের ৫১-৫৩ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مُوسَى إِنَّهُ كَانَ مُخْلَصًا وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا (৫১) وَنَادَيْنَاهُ مِنْ جَانِبِ الطُّورِ الْأَيْمَنِ وَقَرَّبْنَاهُ نَجِيًّا (৫২) وَوَهَبْنَا لَهُ مِنْ رَحْمَتِنَا أَخَاهُ هَارُونَ نَبِيًّا (৫৩)

অনুবাদ: আর স্মরণ কর এই কিতাবে মূসাকে। অবশ্যই সে ছিল মনোনীত এবং সে ছিল রাসূল, নবী। আমি তাকে তূর পর্বতের ডান দিক থেকে ডেকেছিলাম এবং অন্তরঙ্গ আলাপের উদ্দেশ্যে তাকে আমার নিকটবর্তী করেছিলাম। আর আমি নিজ রহমতে তার জন্য তার ভাই হারূনকে নবীরূপে দান করলাম। (সূরা মারায়াম, ৫১-৫৩ আয়াত)।

তাফসীর: মহান আল্লাহ স্বীয় খলীল (আ.)এর বর্ণনার পর স্বীয় কলিমের অর্থাৎ হযরত মূসা কালিমুল্লাহ (আ.)এর বর্ণনা শুরু করেছেন।

‘মুখলাস’-এর অর্থ হচ্ছে, ‘বিশেষভাবে মনোনীত করা, একান্ত করে নেয়া’। অনুরূপভাবে মানুষের মধ্যে সে ব্যক্তি মুখলিস যে ব্যক্তি একান্তভাবে আল্লাহর জন্য আমল করে, মানুষ তার প্রশংসা করুক এটা সে চায় না।

হযরত মূসা (আ.) এ ধরনের বিশেষ গুণে বিশেষিত থাকায় মহান আল্লাহ তাকে তার কাজের পুরস্কার স্বরূপ একান্তভাবে নিজের করে নিয়ে ছিলেন। আল্লাহ তাআলা যে ব্যক্তিকে নিজের জন্যে খাঁটি করে নেন তিনি পরম সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। নবীগণই বিশেষভাবে এ গুণে গুণান্বিত হন, যেমন- পবিত্র কুরআনের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّا أَخْلَصْنَاهُمْ بِخَالِصَةٍ ذِكْرَى الدَّارِ

অনুবাদ: আমি একটি বিশেষ গুণের জন্য তাদেরকে বেছে নিয়েছিলাম। তা ছিল (আখেরাতের) প্রকৃত নিবাসের স্মরণ। (সূরা সোয়াদ, ৪৬)।

অর্থাৎ- তাদেরকে আখেরাতের স্মরণের জন্য বিশেষ লোক হিসেবে নির্বাচন করেছিলাম। সুতরাং তারা আখেরাতের জন্যই আমার আনুগত্য করতো ও আমল করতো। মানুষদেরকে তারা এর জন্য উপদেশ দিত এবং আখেরাতের প্রতি আহ্বান জানাতো।

আর নবীর অর্থ: যিনি আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন বা আল্লাহর ওহীর সংবাদ দেন। অবশ্য নবী ও রাসূল দুয়ের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ, আল্লাহ যে বান্দাকে মানুষের মাঝে পথ প্রদর্শন ও হিদায়াতের জন্য নির্বাচিত করেছেন এবং ওহী দ্বারা সম্মানিত করেছেন, তাঁকে রাসূল বা নবী বলা হয়। প্রাচীন কাল থেকে উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ চলে আসছে যে, রাসূল ও নবীর মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি না এবং থাকলে তা কি? পার্থক্যকারীগণ সাধারণতঃ বলে থাকেন যে, যাঁকে নতুন শরীয়ত তথা আসমানী কিতাব দান করা হয়েছে তাঁকে রাসূল ও নবী বলা হয়। কিন্তু যিনি পূর্ববতী শরীয়ত মোতাবেক মানুষদের কাছে আল্লাহর দ্বীনের কথা পৌঁছে দেন, তাঁকে নবী বলা হয়; রসূল নয়। তা সত্ত্বেও কুরআনে উভয় শব্দই একটি অন্যের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কোথাও পাশাপাশি পৃথক পৃথক অর্থেও ব্যবহার হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

পাঁচজন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ও স্থির প্রতিজ্ঞ রাসূলদের মধ্যে হযরত মূসা (আ.) একজন ছিলেন। সেই পাঁচ নবী হলেন- হযরত নূহ (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত মূসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এবং আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি মহান আল্লাহর মনোনীত নবী ও রাসূল।

তুর পাহাড়ে মহান আল্লাহর সাথে কথোপকথন
তুর পাহাড়। সিরিয়া, মিসর ও মাদইয়ানের মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি সুপ্রসিদ্ধ পাহাড়ের নাম। বর্তমানেও পাহাড়টি এ নামেই প্রসিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা একেও অনেক বিষয়ে বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য দান করেছেন। তুর পাহাড়ের ডানদিকে মূসা আলাইহিস সালামের দিক দিয়ে বলা হয়েছে। কেননা, তিনি মাদইয়ান থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন। তুর পাহাড়ের বিপরীত দিকে পৌঁছার পর তুর পাহাড় তার ডান দিকে ছিল।

হযরত মূসা (আ.) মাদইয়ানে দশ বছর অবস্থান করার পর যখন মিসরের উদ্দেশ্যে সস্ত্রীক ফিরে আসছিলেন, তখন পথিমধ্যে রাত হয়ে যায়। রাস্তাও ছিল অজানা। রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কেউ কেউ বলেছেন, স্ত্রীর প্রসবের সময় ছিল তখন আসন্ন, শীতও ছিল কনকনে। সব মিলিয়ে আগুনের খুব প্রয়োজন দেখা দেয়। যখন তুর পাহাড়ের কাছে আসলেন, তখন আগুন দেখতে পেলেন। পরিবারকে বললেন, তোমরা এখানে অবস্থান কর, আমি আগুন দেখতে পাচ্ছি, আগুন নিয়ে আসলে হয়তো শীত নিবারণ হবে এবং একটা পথও খুঁজে পেতে পারি। অতঃপর যখন তিনি ঐ আগুনের নিকট পৌঁছলেন, তখন আওয়াজ এল, হে মূসা! আমিই তোমার পালনকর্তা। অতএব, তুমি তোমার জুতো খুলে ফেল। কারণ, তুমি পবিত্র তুর উপত্যকায় রয়েছ। আওয়াজটি এসেছিল গাছের আড়াল থেকে। জুতো খোলার নির্দেশ এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, এতে বিনয় বেশি প্রকাশ পাবে এবং অধিক সম্মান প্রদর্শন করা হবে। অথবা সেই জুতো মৃত পশুর চামড়ায় তৈরি ছিল।

মহান আল্লাহ হযরত মূসা (আ.)কে বলেন, আমি তোমাকে রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছি। অতএব, তোমাকে যা আদেশ করা হচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে শোন। আমিই আল্লাহ তাআলা। আমি ব্যতীত আর কোন সত্যিকার মা’বূদ নেই। অতএব, একমাত্র আমার ইবাদত কর।

ভাইকে নবী বানানোর সুপারিশ
মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আমি মূসার (আ.)এর উপর আরো একটি অনুগ্রহ করেছিলাম যে, তাঁর ভাই হারুন (আ.)কে নবী করে তাঁর সাহায্যার্থে তাঁর সঙ্গী করেছিলাম। এটা সে আকাঙ্খা করেছিল ও প্রার্থনা জানিয়েছিল। মহান আল্লাহ তাঁর প্রার্থনার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-

وَأَخِي هَارُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي إِنِّي أَخَافُ أَنْ يُكَذِّبُونِ

অনুবাদ: আমার ভাই হারূনের যবান আমার অপেক্ষা বেশি স্পষ্ট। তাকেও আমার সঙ্গে আমার সাহায্যকারীরূপে পাঠিয়ে দিন, যাতে সে আমার সমর্থন করে। আমার আশঙ্কা তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে। (সূরা কাসাস, ৩৪ আয়াত)।

হযরত মূসা (আ.) তাঁর বড় ভাই হারুন (আ.)কে নবী হিসাবে গ্রহণ করার জন্য মহান আল্লাহর কাছে আবেদন করেছিলেন। এর চেয়ে বড় প্রার্থনা এবং এর চেয়ে বড় সুপারিশ দুনিয়ায় কেউই কারও জন্য করেনি।

লেখক: মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও সহকারী পরিচালক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।