।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।
মহান আল্লাহ সূরা ত্বহার ১৭-৩৫ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-
وَمَا تِلْكَ بِيَمِينِكَ يَا مُوسَى (১৭) قَالَ هِيَ عَصَايَ أَتَوَكَّأُ عَلَيْهَا وَأَهُشُّ بِهَا عَلَى غَنَمِي وَلِيَ فِيهَا مَآرِبُ أُخْرَى (১৮) قَالَ أَلْقِهَا يَا مُوسَى (১৯) فَأَلْقَاهَا فَإِذَا هِيَ حَيَّةٌ تَسْعَى (২০) قَالَ خُذْهَا وَلَا تَخَفْ سَنُعِيدُهَا سِيرَتَهَا الْأُولَى (২১) وَاضْمُمْ يَدَكَ إِلَى جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَيْضَاءَ مِنْ غَيْرِ سُوءٍ آيَةً أُخْرَى (২২) لِنُرِيَكَ مِنْ آيَاتِنَا الْكُبْرَى (২৩) اذْهَبْ إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى (২৪) قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي (২৫) وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي (২৬) وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي (২৭) يَفْقَهُوا قَوْلِي (২৮) وَاجْعَلْ لِي وَزِيرًا مِنْ أَهْلِي (২৯) هَارُونَ أَخِي (৩০) اشْدُدْ بِهِ أَزْرِي (৩১) وَأَشْرِكْهُ فِي أَمْرِي (৩২) كَيْ نُسَبِّحَكَ كَثِيرًا (৩৩) وَنَذْكُرَكَ كَثِيرًا (৩৪) إِنَّكَ كُنْتَ بِنَا بَصِيرًا (৩৫)
তরজমা: (১৭) আর হে মূসা! আপনার ডান হাতে ওটা কী? (১৮) মূসা বললেন, এটা আমার লাঠি; আমি এতে ভর দেই এবং এর দ্বারা আঘাত করে আমি আমার মেষপালের জন্য গাছের পাতা ফেলে থাকি। আর এটা আমার অন্যান্য কাজেও লাগে। (১৯) আল্লাহ বললেন, হে মূসা! আপনি তা নিক্ষেপ করুন। (২০) তারপর তিনি তা নিক্ষেপ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেটা সাপ হয়ে ছুটতে লাগলো। (২১) আল্লাহ বললেন, আপনি তাকে ধরুন, ভয় করবেন না, আমি এটাকে তার আগের রূপে ফিরিয়ে দেবো। (২২) এবং আপনার হাত আপনার বগলের সাথে মিলিত করুন, তা আরেক নিদর্শনস্বরূপ নির্মল উজ্জ্বল হয়ে বের হবে। (২৩) এটা এ জন্যে যে, আমি আপনাকে আমার মহানিদর্শনসমূহের কিছু দেখাবো। (২৪) ফিরআউনের কাছে যান, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে। (২৫) মূসা বললেন, হে আমার রব! আমার বক্ষ সম্প্রসারিত করে দিন। (২৬) এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। (২৭) আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, (২৮) যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। (২৯) আর আমার জন্য করে দিন একজন সাহায্যকারী আমার স্বজনদের মধ্য থেকে; (৩০) আমার ভাই হারূনকে। (৩১) তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন (৩২) এবং তাকে আমার কাজে অংশীদার করুন, (৩৩) যাতে আমরা আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি প্রচুর, (৩৪) এবং আমরা আপনাকে স্মরণ করতে পারি বেশি পরিমাণ। (৩৫) আপনি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা।
তাফসীর: আলোচ্য আয়াতে হযরত মূসা (আ.)কে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া মুজিযার আলোচনা হচ্ছে। মুজিযা রাসূলগণ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে প্রকাশ পাওয়া সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, হে মূসা! আপনার ডান হাতে ওটা কী? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর পক্ষ থেকে মূসা (আ.)কে এরূপ জিজ্ঞাসা করা নিঃসন্দেহে তার প্রতি কৃপা, অনুকম্পা ও মেহেরবানীর সূচনা ছিল। যাতে বিস্ময়কর দৃশ্যাবলী দেখা ও আল্লাহর কালাম শোনার কারণে তার মনে যে ভয় ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর হয়ে যায়। এটা ছিল একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্বোধন। এছাড়া এ প্রশ্নের আরো একটি রহস্য এমন হতে পারে যে, পরক্ষণেই তার হাতের লাঠিকে একটি সাপ বা অজগরে রূপান্তরিত করা উদ্দেশ্য ছিল। তাই প্রথমে তাকে সতর্ক করা হয়েছে যে, আপনার হাতে কী আছে দেখে নিন। তিনি যখন দেখে নিলেন যে, সেটা কাঠের লাঠি মাত্র, তখন একে সাপে রূপান্তরিত করার মুজিযা প্রদর্শন করা হলো। নতুবা মূসা (আ.)এর মনে এরূপ ভাবনাও আসতে পারতো যে, আমি বোধ হয় রাতের অন্ধকারে লাঠির স্থলে সাপই ধরে এনেছি। সুতরাং জ্ঞান লাভ করার বা জানার জন্য এ প্রশ্ন ছিল না।
হযরত মূসা (আ.)কে শুধু এতটুকু প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, হাতে কী? এ প্রশ্নটির উদ্দেশ্য হাতের বস্তুটির নাম কী? অথবা হাতের বস্তুটি কোন কাজে লাগে। এ দু’ধরনের প্রশ্ন উদ্দেশ্য হতে পারে। হযরত মূসা (আ.) অত্যন্ত আদবের সাথে এই দুই সম্ভাবনার জবাবই প্রদান করেছেন। প্রথমে বলেছেন, এটা লাঠি। তারপর কী কাজে লাগে সেটার জবাবও দিয়েছেন যে, এটার উপর আমি ভর দেই। এটা দিয়ে আমি ছাগলের জন্য গাছের পাতা পাড়ি। এতে করে তিনি জানালেন যে, এটা মানুষের যেমন কাজে লাগে তেমনি জীব-জন্তুর কাজেও লাগে। আর এটা আমার অন্যান্য কাজেও লাগে।
মহান আল্লাহ মূসা (আ.)কে বলেন, ওটাকে যমীনে নিক্ষেপ করুন। যমীনে নিক্ষিপ্ত হওয়া মাত্র লাঠিটি বিরাট অজগর সাপে পরিণত হয় এবং এদিক ওদিক চলতে শুরু করে। ইতঃপূর্বে এত ভয়াবহ অজগর কেউ দেখেনি। এ অবস্থা দেখা মাত্রই হযরত মূসা (আ.) আতঙ্কিত হয়ে হাতে কাপড় পেঁচাতে লাগলেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী আসে, হে মূসা! ওটা ধরে নাও। আমি ওকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেবো। যে অবস্থায় ওটার সাথে তুমি পরিচিত ছিলে। এটা ছিল হযরত মূসা (আ.)এর প্রতি প্রথম মুজিযা।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাঁকে নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন, আপনি আপনার হাত বগলের নিচে রাখেন। নিজের বাহু অর্থাৎ বগলের নিচে হাত রেখে যখন বের করবেন, তখন তা চাঁদের আলোর ন্যায় ঝলমল করতে থাকবে। এটা এজন্য যে, আমি আপনাকে আমার বড় বড় নিদর্শনাবলীর কিছু অংশ দেখাতে চাই। এটা ছিল মূসা আলাইহিস সালামকে দেওয়া দ্বিতীয় মুজিযা।
হযরত মূসা (আ.)কে নবুওয়াত ও মুজিযা প্রদান করার পর আল্লাহ তাআলা দাওয়াতি কাজের নির্দেশ দিয়ে ফিরআউনের কাছে প্রেরণ করলেন।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, আপনি মিসরের বাদশা ফিরআউনের কাছে যান। যার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছেন, তাকে আল্লাহর ইবাদাতের দিকে আহ্বান জানান। আর তাকে বলুন, যেন বনী ইসরাঈলের সাথে ভাল ব্যবহার করে। তাদেরকে যেন শাস্তি না দেয়। কেননা, সে সীমালঙ্ঘন করছে, বাড়াবাড়ি করছে, দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়েছে, মহান রবকে ভুলে গেছে। তাই যিকিরের মধ্যে কম করবে না এবং নরম ভাষায় দাওয়াত দাও।
হযরত মূসা (আ.)এর মুখে জড়তা ছিল। যার কারণে তিনি সুস্পষ্টভাবে কথা বলতে পারতেন না। তাই আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করলেন, হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষ উন্মোচন করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন, আমার মুখের জড়তা দূর করে দিন; যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। আর আমার পরিবারের মধ্য থেকে আমার ভাই হারুনকে আমার সাহায্যকারী নিযুক্ত করে দিন। তার মাধ্যমে আমার শক্তিকে আরো বাড়িয়ে দিন। আর তাকে নবুওয়াত দিয়ে আমার দাওয়াতী কর্মে অংশীদার করুন। যাতে আমরা বেশি বেশি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করতে পারি এবং অধিক পরিমাণে আপনাকে স্মরণ করতে পারি।
হারুনকে নবুওয়াতে অংশীদার করলে এই উপকার হবে যে, আমরা বেশি পরিমাণে আপনার যিকির ও পবিত্রতা বর্ণনা করতে পারবো। তিনি বুঝতে পারলেন যে, সমস্ত ইবাদাতের প্রাণ হচ্ছে যিকির। তাই তিনি তার ভাইকে সহ এটা করার সুযোগ দানের দোয়া করলেন।
আপনিই সমস্ত অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত। আর আপনি যেমন আমার বাল্যকালে আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন তেমনি এখনও আপনার অনুগ্রহ হতে আমাকে বঞ্চিত করবেন না।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/