।। ভাষান্তর মাও. আব্দুল করিম ।।
(১৯২৮ সালে হলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হঠাৎ চমকে উঠে রেক্স ইনগ্রামের ইসলাম গ্রহণের বিস্ময়কর সংবাদ শুনে। তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন ফিল্ম ডিরেক্টর। যদি বলা হয় সব চেয়ে সফল ডিরেক্টর তাতেও ভুল হবে না। ১৯২৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘কাহেরা’ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘আস্ সিয়াস’ সংবাদটি প্রথম প্রকাশ করে। ম্যাগাজিনটি আরো জানায়, ইসলাম ধর্মে নিষেধ এমন প্রতিটি কাজ বর্জন করত সম্পূর্ণরূপে ইসলামী জীবন-যাপন করা এবং ফ্রান্সের ‘নিস’ শহরের যে বাড়িতে সর্বপ্রথম তার হৃদয়ে ঈমানের নূর প্রবেশ করেছে, সেখানে বসে ইসলাম ধর্মের জ্ঞান আহরণ করা এখন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য)।
তিনি এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তার জীবন পরিবর্তনের গল্পটি বণর্না করেন। সাক্ষাৎকারটি ‘আদ্ দাওয়াতুস সউদিয়াহ’ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
আমি ইংরেজ পিতা-মাতার ঘরে স্কটল্যান্ডে জন্ম গ্রহণ করেছি। আমার বাবা ১৯০০ সালের ‘বুয়াইর’ যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। তখনও আমি ছোট, তার কথা আমার খুব বেশি মনে নেই। বাবার মৃত্যুর পরও প্রথম বিশ^যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের পরিবারের দিনগুলো ভালোই কাটছিলো। অতঃপর যখন ১৯১৪ সালে চারদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো এবং সারা বিশ্ব ভয়ানক যুদ্ধে জড়িয়ে পরলো। মানুষ দলে দলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে লাগলো। তখন আমিও সাগর পাড়ি দিয়ে ফান্সে চলে এলাম এবং ফান্সের সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিলাম। যুদ্ধ আমাকে এক রণাঙ্গন থেকে অন্য রণাঙ্গনে ঠেলে দিচ্ছিলো।
প্রতিটি রণক্ষেত্র আমার কাছে একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি মনে হচ্ছিলো। পশ্চিমা রণক্ষেত্রে অবস্থানকালে আমি যুদ্ধের যে ভয়াভহ রূপ ও বিভীষিকাময় অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি তার বণর্না দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দীর্ঘ চার বৎসর রণাঙ্গনে অবস্থান করার পর ১৯১৮ সালের শেষ দিকে আমি স্বদেশে ফিরে আসি। এখানে এসে জানতে পারি আমার মা ও তিন ভাই সবাই যুদ্ধে মারা গেছে। আমার আপন বলতে আর কেউ বেঁচে নেই।
এরপর থেকে আমি গন্তব্যহীনভাবে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম, চীন, জাপান, ভারত ও আরবসহ অনেক দেশ চষে বেড়ালাম কিন্তু ধর্ম ও ভাষা অধ্যয়ন ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। যা অবলম্বন করে আমি আমার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি। সিরিয়ায় এসে আমি আরবী ভাষা শিখেছি এবং বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে অধ্যয়ন করেছি। পবিত্র কুরআন অধ্যয়নে আমি যে শান্তি ও সান্ত¡না লাভ করেছি তা অন্য কোথাও পাইনি। আমি বারবার পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করেছি, গভীরভাবে তার মর্ম অনুধাবন করে হৃদয়পটে ধারণ করার চেষ্টা করেছি। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের অপারসুখ ও মায়াবী আকর্ষণের ফলে কুরআন তেলাওয়াত ব্যতীত একটি দিনও কাটাতে পারতাম না।
বিস্ময়কর একটি স্বপ্ন
ত্রিশের দশকে যখন আমি আলেক্সান্দ্রিয়াতে আসলাম। তখন অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলতে চলতে আমি ‘দিমনাহুর’ নামক জায়গাতে এসে পৌঁছলাম। ক্লান্ত শরীরে একটু বিশ্রামের উদ্দেশ্যে যখন একটি লেকের কিনারে এসে বসলাম, লেকের শীতল বাতাসে আমার দু চোখ ভেঙে ঘুম চলে আসলো। আমি ঘুমের মধ্যে দেখতে লাগলাম জমিন থেকে এক প্রকার ধোঁয়া আকাশের দিকে উঠতে লাগলো এবং তা ধীরে ধীরে ঘনিভূত হয়ে জমাটবদ্ধ হতে লাগলো, তা থেকে বিস্ময়কর আলোর ফোয়ারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই জমাটবদ্ধ ধোঁয়া ‘আল ইসলাম’ শব্দের রূপ ধারণ করলো।
এরপর আমার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পরও ‘আল ইসলাম’ শব্দটি আমার চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ভেসে ছিলো। আমি এর পূর্বে কখনও ইসলাম গ্রহণের কথা ভাবিনি। এই স্বপ্ন দেখার পর আমি প্রথম বারের মতো আত্মিক প্রশান্তি লাভ করলাম। পথে যে গ্রামের পাশ দিয়েই আমি চললাম সেই গ্রামের অধিবাসীরাই আমাকে সালাম দিলো, খাবারের দাওয়াত দিলো, পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করলো এবং তাদের বাড়িতে মেহমান হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। অথচ আমি পশ্চিমের অধিবাসী তারা প্রাচ্যের। আমাদের চাল-চলন ভিন্ন, দ্বীন ভিন্ন, তবুও কেনো তারা আমাকে এমন সম্মান দিচ্ছে!?
আমি পশ্চিমাদের দেখেছি তারা একে অপরকে কতোটা সন্দেহের চোখে দেখে। যদি তুমি ইউরোপিয়ান কোনো কৃষকের পাশ দিয়ে যাও, আর তাকে সালাম করো, তাহলে কি সে তোমাকে এমন সম্মান করবে? যদি কোনো ইউরোপিয়ানকে খেতে দেখো এবং তার পাশে গিয়ে দাঁড়াও তবে কি সে আন্তরিকতার সাথে তোমাকে তার খাবারে শরিক করবে? যদি কখনো বিপদে পড়ে তাদের কারো বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াও তবে কি সে দরজা খুলে তোমাকে মেহমান হিসেবে ঘরে নিয়ে যাবে ?
এসব প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। আমি এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলাম। তখন আমার মনের গভীর থেকে আওয়াজ আসতে লাগলো; না, এটা মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো জাতির পক্ষেই সম্ভব নয়। একমাত্র ইসলামই মুসলমানদের এই মহান শিক্ষা দিয়েছে এবং তাদেরকে এমন উন্নত চরিত্রের অধিকারী বানিয়েছে।
আমি আরো একদিন অনুরূপ একটি স্বপ্ন দেখতে পেলাম, একটি ধোঁয়ার কুন্ডলী আলোর হরফে পরিবর্তন হয়ে গেলো, আর সেই আলোর হরফগুলো দিয়ে ‘আল ইসলাম’ শব্দটি গঠিত হলো। ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর আমার মনের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো, মহান আল্লাহ তা’আলা আমার জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে নির্বাচন করেছেন।
আমি এ কথা ভেবে এক পরম শান্তি অনুভব করলাম যে, আমি শান্তি, সহমর্মিতা ও পরোপকারের ধর্ম আল ইসলাম গ্রহণ করতে চলেছি। যা মানুষের হৃদয়কে শান্তি ও স্বস্তি দান করে, পার্থিব জীবনে মানুষের আত্মিক প্রশান্তি ও আরাম নিশ্চিত করে। সর্বোপরি আল্লাহর ফয়সালার উপর বিশ^াস রাখা ও বস্তুবাদী সুখ-দুঃখের দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার পরম নেয়ামত লাভে ধন্য করে।
দীর্ঘ অধ্যয়নের পর আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি
আমি শুধুমাত্র একটি স্বপ্ন কিংবা সাময়িক আবেগের বশবর্তী হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিনি বরং ইসলাম ধর্ম নিয়ে বহু বৎসর যাবত গভীর অধ্যয়ন, দীর্ঘ গবেষণা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি। অতঃপর যখন ইসলাম ধর্মের সত্যতার ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চিত হয়েছি তখনই এই মহান ধর্ম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি; উন্মত্ত জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে, নিরবতা ও ধ্যান মগ্নতার মাঝে একটু শান্তি লাভ করতে এবং ঐ সমস্ত চিন্তা-ভাবনার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে যেতে যা মানুষকে ধন-সম্পদ ও জীবিকার পিছনে পঙ্গপালের ন্যায় ছুটতে বাধ্য করে। যা বর্তমানে মানুষদের মা’বুদ ও ঈশ্বরে পরিণত হয়েছে।
আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি মদ ও মাদকতার বিষাক্ত ছোবল থেকে আত্মরক্ষার্থে। অশ্লীলতার অশুভ পরিণতি ও কৃত্রিম জীবনের রঙিন ধোঁকা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে। আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি আমার জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক ও জীবনকে ধ্বংস আর বরবাদির হাত থেকে বাঁচাতে।
আমার মনে আছে, একবার আমি একটি ফিল্ম তৈরির কাজ করছিলাম, তখন আমার একটি আযানের শুট নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিলো। শুটটি ছিলো একজন দীর্ঘকায় গম্ভীর আরবী মুয়াজ্জিন মিনারার চূড়ায় দাঁড়িয়ে সুমধুর কন্ঠে নামাযের জন্য আযান দেওয়ার। সে যখন আযান দিচ্ছিলো তখন আমি তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তার সুমধুর আযানের ধ্বনির উত্থান পতন আমার হৃদয়ের গভীরে ঢুকে যাচ্ছিল।
ফিল্মের শুটিং শেষ হওয়ার পর আমি ঐ লোকটিকে আমার অফিস কক্ষে ডেকে নিলাম। তাকে ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। আমি তার কথাগুলো শুনে আর কালক্ষেপণ না করে ইসলাম গ্রহণ করে ফেললাম। তার সাথে নামায আদায় করতে শুরু করলাম। নামাযে এমন আত্মিক প্রশান্তি লাভ হলো যা আমার হৃদয়-মনকে এক অপার্থিব সুখে প্লাবিত করতে লাগলো। আমার নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হতে লাগলো। এক সময় যে সকল কামনা বাসনা আমার রঙিন স্বপ্ন ছিলো তা এখন আমার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়লো।
আল্লাহর সামনে পূর্ণ আত্মসমর্পণ
অবশেষে আমার সামনে সেই দিনটি আসলো যে দিন আমি বুঝতে পারলাম “আমার পক্ষে ফিল্মের কাজ ও ইসলাম ধর্মের কাজ এক সাথে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাকে অবশ্যই যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে।” আমি খুবই মানসিক চাপের মধ্যে পরে গেলাম। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ধর্মের কারণে ভবিষ্যৎ কুরবান করবো নাকি ভবিষ্যৎ এর জন্য ধর্ম?
এই টানপোড়েনের মধেই আমি রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটাতে লাগলাম। কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়? কোনটাকে ধরবো কোনটাকে ছাড়বো? অবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তর আসলো। আমাকে অবশ্যই হলিউডের সকল প্রকার ধোঁকা ও প্রবঞ্চনা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। এই সিদ্ধান্ত আমার জন্য খুবই কষ্টদায়ক ছিলো। তখন আমি ‘নিস’ শহরে একটি ফিল্মের কাজ করছিলাম।
এক রাতে আমি দীর্ঘ সময় নামায আদায় করলাম ফলে আমার ঈমানী শক্তি অনেক বেড়ে গেলো যা আমাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করলো। পরবর্তী দিন আমি নিজেকে ফিল্মের কাজ থেকে সম্পূর্ণ রূপে সরিয়ে নিলাম এবং নিজের জান, মাল সব কিছু ইসলামের জন্য সঁপে দিলাম। আমি আজ একজন খাঁটি মুসলমান। আমি আজ অনেক খুশি, অনেক আনন্দিত ঐ সব দিন থেকে যা আমি আমার পশ্চিমা শহরে পশ্চিমা পোশাকে পশ্চিমা বন্ধুবান্ধবদের সাথে কাটিয়েছি।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/