হালযামানা: সমসাময়িক বিষয়ে মন্তব্য প্রতিবেদন

নিজেদের শুধরে নিতে হবে

দুর্নীতি কাকে বলে কত প্রকার ও কী কী দেশবাসী তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তবে তারা অসহায়। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমার মনে হয় এখন দুর্নীতিবাজরা আগের চেয়েও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ সেপ্টেম্বর-২০২১)।

পাঠক কলাম এর একটি লেখায় এক লেখক হঠাৎ দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, বেচারা লেখকের সাদামাটা সাবলীল ভঙ্গিতে দুর্নীতির চিত্রটা ফুটিয়ে তোলার চেয়ে তার অসহায়ত্বটাই আমার কাছে উপজীব্য বিষয়! বাংলাদেশে দুর্নীতি এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে! কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে সেটার চেয়ে কোথায় দুর্নীতি নেই সেটাই এখন খুঁজতে হয়। দুর্নীতি, মিথ্যাচার, প্রতারণা ও অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করার যে রোলার কোস্টার বাংলাদেশে চলছে, সেখানে লাখ টাকার দুর্নীতি, কোটি টাকা আত্মসাৎ বা শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় না!! সেটা ছাড়িয়ে আজকে কে কত হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে নাম লেখাল, কে কত হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করে নিয়ে গেল তাই আলোচনার জন্ম দেয়! ৭ই জুন সিপিডির দেওয়া তথ্যমতে বর্তমানে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ৩৫ ভাগ এর মতো। করোনা অতিমারীর সময় দরিদ্র আরো দরিদ্র হয়েছে, ধনী হয়েছে আরো ধনী। কারণ, বাংলাদেশ চলছে ‘যত দুর্গতি তত দুর্নীতি’ এই থিওরির ভিত্তিতে। জনপ্রতিনিধিদের অসহায় দুস্থ মানুষের চাল-ডাল আত্মসাৎ করে খাটের তলায়, উঠোনের মেঝেতে মাটির নিচে, বস্তাবন্দি করে পুকুরের পানিতে লুকিয়ে রাখার যে প্রবণতা দেখা গেছে, এ দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি অবাক হয়নি। দরিদ্র মানুষের সান্তনার জন্য ১০২ জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সুস্থ মানুষকে অসুস্থ বানানো, আবার অসুস্থ মানুষকে দিব্যি সুস্থ বানানো বাংলাদেশের মানুষের পক্ষেই সম্ভব, ভুয়া পরীক্ষার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে! যা আমাদের দেশকে এনে দিয়েছে অন্যরকম এক পরিচিতি!! দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ শিরোনাম হয়েছে- ‘বিগ বিজনেস ইন বাংলাদেশ: সেলিং ফেক করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট’।

দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা বর্তমানে হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতি হিসেবে মানুষ হিসেবে আমরা ব্যর্থ, ইসলাম ও ধর্মের বিষয় তো বহুদূরের পথ। জাগতিক পরিণতিই তো আমরা চিন্তা করি না, তাই মহাবিচার দিবসের কাঠগড়ার চিন্তা আমাদের খুব একটা ভাবায় না। তবু কিছু মানুষ, কিছু মানবতা, কিছু চিন্তা মানবজাতিকে মুক্তি দিতে পারে। আর তা হলো নিজেকে বদলানো, নিজেকে শোধরানো, নিজেকে বিবেকের আদালতে সোপর্দ করা, তখনই দুর্নীতি মানুষকে খুজবে, দুর্নীতি হবে পরিত্যাজ্য।

ইন্টারনেট প্রযুক্তি: নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক ব্যাধি

দীর্ঘ ১৮মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর খুলে দেয়া হয়েছে। স্কুল খোলার পর আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির ব্যবহার, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের আসক্তির নমুনা পাওয়া গেল টিকটক ভিডিওর মাধ্যমে। দাউদকান্দিতে ইবনে তাইমিয়া স্কুল এন্ড কলেজে একদল মেয়ে শিক্ষার্থী অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে টিকটক ভিডিও বানিয়ে তারই প্রমাণ দিলেন। জানান দিলেন মোবাইল ও ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে অবাধ বিচরণ ও শক্তিশালী উপস্থিতির। এইতো কিছুদিন আগে কুমিল্লার একটি মডেল মসজিদের বারান্দায় অশ্লীল নাচ ও অঙ্গভঙ্গির টিকটক ভিডিও করে সমালোচনা এবং নিন্দার খোরাক হয়েছিলেন দুজন তরুণ-তরুণী এবং পুলিশের হাতে ধৃত হয়ে নিজেদের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। শিশু-কিশোর এবং যুবকদের সর্বোপরি সব মানুষের ইন্টারনেট প্রযুক্তি এবং মোবাইল ফোনের আসক্তি সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করছে।

টিকটক, অশ্লীল ভিডিও,পর্নোগ্রাফি, মোবাইল গেমিং, কল স্পুফিং করে প্রতারণা, সেলফি, লাইকি কিশোর তরুণ তরুণী এবং তরুণ সমাজকে ধ্বংসের চূড়ান্ত পথে ঠেলে দিচ্ছে। ইন্টারনেটের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা কমবেশি সব সময় হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আলোচনা করেন এই প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং মারাত্মক কুফল সম্পর্কে, খবর নিয়ে দেখা যাবে তার নিজের পরিবারে প্রত্যেকটি তরুণ-তরুণী এবং কিশোর যুবক মোবাইল ফোনে আসক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অত্যাধিক গেমিং আসক্তিকে মানসিক রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ইউএসএ তে এক জরিপে দেখা যায়, ৬২% যুবসমাজ (১২-১৬) প্রযুক্তির কারণে যৌন হয়রানি এবং বড় বড় প্রযুক্তিগত অপরাধের সাথে জড়িত।

আরও পড়তে পারেন-

একটা সময় ছিল আমাদের দেশে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা স্কুল শেষে মাঠ-ঘাট দাপিয়ে বেড়াতো বিভিন্ন খেলাধুলা ও খুনসুটিতে। অবসর সময় পেলেই গোল্লাছুট, ঘুড়ি ওড়ানো, সাঁতার কাটা, বৃষ্টিতে ভেজা, বিলে শাপলা-শালুক তোলা, ফুটবল খেলাসহ আরো নানা রকম গ্রামীণ খেলায় মেতে উঠতো। আর শহরের তরুণ কিশোর বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত হতো। বই পড়া, পার্কে ঘুরতে যাওয়া, বাগান করা, ছাদে আড্ডা দেয়া, শিক্ষামূলক তর্ক বিতর্ক করা, স্কুলে বিতর্কের প্রস্তুতি নেয়া এবং নানা রকম সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল কাজে জড়িত থাকত। অথচ বর্তমানে শহর থেকে গ্রাম, নগর থেকে অজ পাড়া গাঁ, এমনকি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহেও মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট আসক্তির কারণে সুস্থ ও সামাজিক বিধি-নিষেধ, সমাজ কাঠামো, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক বন্ধন গুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। দুই আড়াই বছরের শিশু থেকে নিয়ে ৭০-৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ পর্যন্ত মোবাইলের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে সবসময়। শিশু-কিশোরদের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে তাদের সোনালি জীবন। তরুণ-যুবক ধ্বংস করছে তাদের যৌবন, তাদের ক্যারিয়ার। বৃদ্ধরা ধ্বংস করছে তাদের মৃত্যুর প্রস্তুতির শেষ সময়টুকু পর্যন্ত!

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- সৌভাগ্যবান কারা? তিনি বললেন- সৌভাগ্যবান তারা, যারা দীর্ঘায়ূ লাভ করেছে এবং তা নেক আমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে। আবার জিজ্ঞাসা করা হল, দুর্ভাগা কারা? তিনি বলেন- দুর্ভাগা তারা, যারা দীর্ঘায়ু পেয়েছে, কিন্তু বৃহৎ সময়কে আমলহীন অতিবাহিত করেছে। (তিরমিযী-২৩২৯)। এখনও যদি আমরা কার্যকর পদক্ষেপ না নেই, সচেতন না হই, আমাদের সন্তানদের এবং নিজেকে রক্ষা না করি,তাহলে ধ্বংসের অতল গহ্বরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মসহ নিমজ্জিত হতে খুব বেশি দেরি নেই।

গ্রন্থনায়- শফিকুল ইসলাম আমিনী

শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ক্ষতি বয়ে আনার আয়োজন চলছে না তো?

২৬ সেপ্টেম্বর রোববার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হলে প্রবেশের সময় আপত্তিকর স্টাইলের চুল দেখে শিক্ষিকা কর্তৃক ১৪ শিক্ষার্থীর চুল কাটার ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন এবং এর প্রেক্ষিতে শিক্ষিকার পদত্যাগসহ অনেক কিছুই ঘটে গেল। এখানেই শেষ হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার চুল কাটার ঘটনায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে চুল কাটার ঘটনা কেন অবৈধ হবে না তাও জানতে চেয়েছে আদালত।

অন্যদিকে এ ঘটনায় দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও টিলিভিশন চ্যানেলও পিছিয়ে না থেকে শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবেদন, মতামত ও টকশো প্রচারসহ সোশ্যাল মিডিয়াতেও অনেকে বুঝে/না বুঝে প্রতিবাদ ও বিষোদ্গারমূলক পোস্টের ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন।

আমি ভাবছি, চুল কাটার ঘটনাকে বাড়াবাড়ি রকমের মনে হলেও এই নিয়ে বড় জোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকাকে সতর্ক বা ভর্ৎসনা করাই কি যথেষ্ট হতো না!

যে শিক্ষকের কাছ থেকে ছাত্ররা নীতি-নৈতিকতা ও আদব-কায়দার অনুশীলনসহ মূল শিক্ষার পাঠ নিয়ে থাকে, সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে লঘু অপরাধের গুরু শাস্তি দাবি করে দুর্বার ছাত্র আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শিক্ষকের চাকরি খোয়ানো এবং আদালতের দিক থেকে বড় অংকের অর্থ জরিমানার আদেশ জারির শঙ্কা তৈরি হওয়া এবং এই নিয়ে মূলধারার মিডিয়াসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড়, সামাজিক নাজেহাল… এসব কিছুর দীর্ঘমেয়াদে এক গভীর নেতিবাচক প্রভাব কি পুরো শিক্ষক সমাজের উপর পড়বে না!

শিক্ষকরা আগামী দিনে ছাত্রদেরকে নৈতিক, আদর্শিক, অপরাধমূলক ও শিক্ষাবিষয়ক গাফলতিতে কোনরূপ শাসন করতে এবং নৈতিকতার শিক্ষা দিতে আর আগ্রহী হবেন বা মনোবল খুঁজে পাবেন?! আর এতে করে শিক্ষকরা ছাত্রদের যে কোন অনৈতিকতায় যদি দর্শকের ভূমিকায় থাকেন, তবে এ জন্য শিক্ষকদেরকে দায়মুক্তি দেওয়া হবে কি? না তখন ছাত্রদের অনৈতিকতা সামলাতে বা বন্ধ করতে না পারার জন্যও শিক্ষককে দায় নিয়ে চাকরি খোয়ানোর মতো শাস্তির মুখে পড়তে হবে!

যদি আমরা কোনটাই না চাই, তাহলে কেন পিতৃতূল্য মর্যাদার শিক্ষকের লঘু ভুলের জন্য তাকে হেনস্থা ও এত কঠিন শাস্তি দেওয়া এবং কেন শিক্ষক সমাজকে শিক্ষকতার পেশার উপর বিরক্ত বা বীতশ্রদ্ধ করার ক্ষতিকর প্রতিযোগিতা! এতে কার্যত গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বড় রকমের ক্ষতি বয়ে আনার আয়োজন হচ্ছে না তো? এতে গোটা ছাত্র সমাজ শাসন বঞ্চিত হয়ে প্রকৃত অর্থে ক্ষতির মুখে পড়বে না তো! গভীরভাবে পর্যালোচনা দরকার।

জাতি হিসেবে যারা আমাদের উন্নতি চায় না, গোটা জাতিকে যারা নিরক্ষর শ্রমিক বা ভোক্তা করে রাখতে চায়, বহুদূর থেকে তাদের ইশারাও এই ঘটনায় ইন্ধন যোগাতে কাজ করছে না, এমন সংশয়ও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

– ইফতিখার আহমদ (আতিক)

মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।