হালাল উপার্জন: ইবাদত ও দোয়া কবুলের পূর্বশর্ত

।। আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী ।।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। ইসলামে শরীয়তের সকল বিধান নিহিত রয়েছে। ইসলামী শরীয়াতের অন্যতম বিধান হলো হালাল রুজি-উপার্জন। হালাল রুজি ব্যতীত কোন ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন না।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, “হে মানব ম-লী, পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা-১৬৮) ।

ইসলামী শরীয়ত যা হারাম করেনি, বরং হালাল ঘোষণা করেছে তা হালাল রুজি হিসেবে গ্রহণযোগ্য। হালাল বা বৈধ উপায়ে রুজি উপার্জন করা প্রতিটি মুসলমানের উপর অপরিহার্য কর্তব্য। কারো জন্য রুজি-উপার্জন করার প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও তাকে অবশ্যই হালাল রুজি ভক্ষণ, পরিধান ও ভোগ করতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা যেমন নিজে পবিত্র, তেমনি, তিনি পবিত্রতা ভিন্ন অন্য কিছু গ্রহণ করেন না। হালাল বা বৈধ হওয়া দু’দিক থেকে হতে পারে। যেমন-

(ক) শরীয়তে যাকে হালাল ঘোষণা করা হয়েছে অথবা হারাম করা হয়নি। (খ) হালাল বা বৈধ উপায়ে অর্জিত। সম্পদ অর্জনের বৈধ পদ্ধতিসমূহের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, নিজ জমিতে উৎপাদিত ফসল, বৈধ ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফা ও শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ।

কুরআনের বহুসংখ্যক আয়াতে আল্লাহ তাআলা হালাল রুজি উপার্জনের কথা বলেছেন। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- হে ঈমানদারগণ, আমি তোমাদেরকে যে সকল পবিত্র বস্তু জীবিকারূপে দান করেছি, তা হতে ভক্ষণ করো এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, যদি তোমরা একান্তভাবে তার ইবাদত করো। (সূরা বাকারা- ১৭২)।

হালাল রুজি উপার্জনের কথা অনেক হাদিসে এসেছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, হালাল উপার্জনের চেষ্টা করা ফরযের পরে ফরয। (বায়হাকী)।

শতভাগ হালাল উপার্জন নিশ্চিত করার স্বার্থে হারামকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করাসহ হারামের ধারে-কাছে না যাওয়া ও সন্দেহপূর্ণ বিষয় পরিহার করে দূরে অবস্থান করা। হারাম বিষয় চাকচিক্যময় হওয়া সত্ত্বেও হাদিসে তাকে সবুজ ঘাসের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মানুষের মন যদি দ্বীন ও শরীয়ত মোতাবেক চলার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়, তবেই শরীয়তের উপর সুদৃঢ় থাকা সম্ভবপর হয়, অন্যথায় নয়। কেননা, অন্তকরণ হচ্ছে শরীরের চালক। তাই সকলের উচিত নিজ নিজ অন্তকরণের পরিশুদ্ধি অর্জনে সচেতন হওয়া।

আরও পড়তে পারেন-

হালাল উপার্জনের বহুবিধ মাধ্যম রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে হালাল কাজ করে তার বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণের মাধ্যমে হালাল উপার্জন করা। মসজিদ-মাদ্রাসার খেদমত, কৃষিকাজ, সামর্থ অনুযায়ী ব্যবসা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চাকরি করে হালাল উপার্জন করা যায়। এছাড়াও পশুপালন, হাঁস-মুরগির খামার প্রতিষ্ঠা, মৎস্য চাষ, বৃক্ষরোপণ, নার্সারি প্রতিষ্ঠা, কুটিরশিল্প, শিল্পকারখানা ইত্যাদিতে কাজ করে হালাল রুজি উপার্জন করা যায়।

অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকার উপায়- (ক) আল্লাহকে ভয় করা। আল্লাহকে ভয় করাই হলো অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকার প্রধান উপায়। যে আল্লাহকে ভয় করবে সে অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকতে পারবে।
মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ মকরেন- হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করো, তাকে যেরূপ ভয় করা উচিত। তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)।

(খ) মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। মৃত্যুর কথা স্মরণ করার মাধ্যমে অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকা যায়। যে মৃত্যুর কথা স্মরণ করবে সে অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকতে পারবে।

মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই, যদি তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের ভেতরে অবস্থান করো, তবুও। (সূরা নিসা- ৭৮)।

(গ) কুরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন করা। কুরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যকর্তব্য। হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরয। (ইবনে মাজাহ)।

(ঘ) অতিমাত্রায় সম্পদের লোভ পরিহার করা। অতিমাত্রায় সম্পদের লোভ পরিহার অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকার অন্যতম উপায়।

(ঙ) লজ্জাশীলতা মেনে চলা। লজ্জা ঈমানের অংশ। লজ্জা অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকার জন্য সহায়ক। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা জনৈক আনসারীর নিকট দিয়ে গমন করছিলেন। আনসারী সাহাবী তখন তার ভাইকে লজ্জা সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, তাকে ছেড়ে দাও। কেননা, লজ্জা ঈমানের অংশ। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।

(চ) হিংসা-অতৃপ্তি পরিহার করা। হিংসা-অতৃপ্তি পরিহার করতে পারলে অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকা যাবে।

হালাল উপার্জনের সুফল

ক) একটি ফরয ইবাদত। হালাল রুজি উপার্জন ফরয ইবাদতের পর একটি ফরয।

(খ) জান্নাতের সুসংবাদ। যে হালাল উপার্জন করবে ও শরীয়তের সঠিক বিধিবিধান মেনে চলবে তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে। হযরত জাবির (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে গোশত হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। হারাম খাদ্যে গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামের আগুনই উত্তম। (আহমাদ, বায়হাকী)।

(গ) ইবাদত কবুল হওয়া। হালাল উপায়ে অর্জিত ও শরীয়ত অনুমোদিত সম্পদ বা খাদ্য গ্রহণ ছাড়া আল্লাহর কাছে কোন ইবাদতই কবুল হবে না।

(ঘ) দুআ কবুল হওয়া। প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য হালাল রুজি অর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। কেননা, হালাল সম্পদ বা খাদ্যই হলো দুআ কবুলের শর্তসমূহের মধ্যে অন্যতম শর্ত।

(ঙ) আত্মার সঠিক খাদ্য। হালাল রুজি উপার্জন আত্মার সঠিক খাদ্য যোগাতে সাহায্য করে।

প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য হালাল রুজি অর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। কেননা, হালাল সম্পদ বা খাদ্যই হলো ইবাদত কবুলের শর্তসমূহের মধ্যে অন্যতম শর্ত। হালাল উপায়ে অর্জিত ও শরীয়ত অনুমোদিত সম্পদ বা খাদ্য গ্রহণ ছাড়া আল্লাহর কাছে কোন ইবাদতই কবুল হবে না।

পরিশেষে বলব, হালাল রুজি অর্জন ব্যতীত (আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যতীত) জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, হালাল রুজি অর্জন ছাড়া কোন আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সকল আমল, সকল ইবাদত কবুলের জন্য এবং আল্লাহকে খুশি করার জন্য ও জান্নাত লাভের জন্য আল্লাহ আমাদের সকলকে হালাল রুজি উপার্জনের তাওফীক দিন। আমীন।

– আল্লামা হাফেয নাজমুল হাসান কাসেমী, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- জামিয়াতুন নূর আল কাসেমিয়া-উত্তরা, ঢাকা ও রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদরাসাসা-উত্তরা, ঢাকা এবং খতীব- উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদ, ঢাকা।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।