।। মুহাম্মদ আবদুল হাকীম ।।
কাল পরিক্রমায় আমাদের মাঝে আসন্ন হিজরী নববর্ষ। হিজরী নববর্ষ মুসলিম জাতির ইতিহাসে এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। হিজরী নববর্ষ মুসলমানদেরকে তাদের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তাদেরকে নব চেতনায় উদ্দীপ্ত করে। তাই তা একজন মুসলমানের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। একজন মুসলমানের জন্য হিজরী নববর্ষের ইহিহাস জানা এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনকে আলোকজ্জ্বল করা অপরিহার্য।
হিজরী নববর্ষের ইতিহাস
প্রাচীনকালে মানুষ সাধারণত প্রসিদ্ধ ঘটনা দ্বারা তারিখ নির্ণয় করত। সাধারণ ও বিশেষ সবার কাছেই এ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। তখন ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জির কোনো প্রচলন ছিল না।
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ.(মৃ.৯১১হি.) উল্লেখ করেন, প্রথমে মানুষ আদম আ. এর পৃথিবীতে আগমনের দিন দ্বারা তারিখ হিসাব করত। যখন হযরত নূহ আ. এর প্লাবনে অধিকাংশ মানুষ ধ্বংস হয়ে গেল, তখন অবশিষ্ট মানুষ হযরত নূহ আ.এর প্লাবনের দিন দ্বারা তারিখ নির্ণয়ের সূচনা করল। হযরত নূহ আ. এর সন্তানেরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেকে যার যার পদ্ধতিতে তারিখ স্মরণ রাখতে লাগল।
এক সময় আরবরা ইবরাহীম আ. এর অগ্নিকু-ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনা দিয়ে তারিখ গণনা করত। অতঃপর ইসহাক আ. এর সন্তানেরা (ইয়াহুদ) বছরের হিসাব রাখার জন্য ইউসুফ আ. থেকে মূসা আ. পর্যন্ত, মূসা আ. থেকে সুলাইমান আ. পর্যন্ত, আর পরবর্তীতে সুলাইমান আ. থেকে ঈসা আ. পর্যন্ত তারিখ গণনা জারি রাখে। ইসমাঈল আ. এর সন্তানেরা বাইতুল্লাহর নির্মাণের সময় থকে সাল-তারিখ গণনার সূচনা করেছে। পরবর্তীরা কা’ব বিন লুয়াই এর ইনতেকাল থেকে নতুন হিসাব শুরু করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগের কুরাইশরা হস্তিবাহিনীর ঘটনার বছর থেকে সাল হিসাব করা শুরু করেছে। পরে মুসলমানরা হিজরতের বছর থেকে হিজরী বর্ষ গণনা শুরু করে। অপরদিকে রোমকরা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের যুগ থেকে সাল গণনা করত। পারসিকরা তাদের প্রত্যেক বাদশার ক্ষমতাসীন হওয়ার দিন থেকে বর্ষ গণনা করত।
বর্ষপঞ্জির সূচনা ইতিহাস রচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন সরকার নানা সময়ে নিজেদের মত করে বর্ষপঞ্জি প্রস্তুত করেছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে দু’টি বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার। এক. খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জি। যা খৃস্টান পাদ্রী ও সরকারের তত্ববধানে হযরত ঈসা আ. এর জন্ম সন থেকে গণনা করা শুরু হয়। এটা সৌর বর্ষপঞ্জি হিসেবেও প্রসিদ্ধ। দ্বিতীয়টি হল, হিজরী বর্ষপঞ্জি, যা চাঁদের হিসাব অনুযায়ী মুসলমানদের মদীনায় হিজরত কাল থেকে শুরু হয়েছে।
আরবরা তাঁদের সহজতার জন্য চান্দ্র মাসঃ মুর্হারম, সফর, রবীউল আউয়াল ইত্যাদি গ্রহণ করেছিল। তবে এগুলোর ভিত্তিতে বছরের হিসাব রাখা হতো না; বরং তা করা হত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে। যেমন, অমুক যুদ্ধের পরবর্তী মুর্হারম। অমুক চুক্তির পূর্ববর্তী রমাযান। এভাবে তাদের সাদামাটা সভ্যতার প্রয়োজন মিটে যেত। অধিকাংশ লেনদেন মৌখিকভাবেই স্থির হত । দলীল-দস্তাবেজ, কাগজের টুকরা ও লেখার চর্চা ছিল বটে, কিন্তু দীর্ঘ সময়ব্যাপী সংরক্ষণ করার প্রচলন ছিল না। এজন্য পৃথক পৃথক বছরকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ তাদের আসেনি। একারণে তাদের কখনও কোনো সমস্যাও দেখা দেয়নি। হযরত উমর ফারুক রা. এর যুগে আরবরা প্রথম যখন পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমাঞ্চলের কর্তৃত্ব লাভ করল এবং সরকারী রেজিষ্ট্রারে চিঠিপত্র, রসীদ ও অন্যান্য দলীল-দস্তাবেজের স্তুপ পড়ে যেতে থাকল, তখন কোন লেখাটি কোন বছরের এটা জানা কঠিন হয়ে পড়ল।
এমতাবস্থায় হযরত আবু মূসা আশআরী রা. হযরত উমর রা. কে এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি লিখলেন, আমাদের কাছে আপনার এমন চিঠি আসে যাতে তারিখ লেখা থাকে না। আপনি (অনুগ্রহ করে) কোনো তারিখ নির্ধারণ করুন। ঐতিহাসিক এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, ইয়েমেন থেকে আগত এক ব্যক্তি হযরত উমর রা. কে এই পরামর্শ দেন যে, ইয়েমেনবাসী তাদের চিঠিতে তারিখ উল্লেখ করে থাকে আপনিও এরকম কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। (আশ শামারীখ ফী ইলমিত তারীখ, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতীকৃত,পৃ. ১৪, ১৫)।
আরও পড়তে পারেন-
- মুসলমানদের জন্য রোগ-ব্যাধিতে চিকিৎসা করানো সুন্নাত
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- মাহে মুহাররম ও আশূরা: করণীয় ও বর্জনীয় আমলসমূহ
এক বর্ণনায় এসেছে, হযরত উমর রা. এর কাছে এক চিঠি আসল, যাতে শুধু শা’বান মাসের উল্লেখ ছিল। হযরত উমর রা. বললেন, এটা কোন বছরের শা’বান, কীভাবে বোঝা যাবে? তখন হযরত উমর রা. সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন, মানুষের জন্য কোনো সময় নির্ধারণ করুন। যার মাধ্যমে তারা তারিখ গণনা করতে পারবে। কেউ কেউ বলল, রোমকদের তারিখ গ্রহণ করে নিন। হযরত উমর রা. বললেন, রোমকদের তারিখ গণনা অনেক দীর্ঘ। তারা তো আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের যুগ থেকে তারিখ গণনা করে। কেউ বলল, পারসিকদের তারিখ গ্রহণ করে নিন। হযরত উমর রা. বললেন, তারা তো প্রত্যেক বাদশার ক্ষমতাসীন হওয়ার ভিত্তিতে নতুন করে তারিখ গণনা শুরু করে থাকে। (আশ শামারীখ, পৃ. ১৭)।
সর্বশেষ স্বতন্ত্র বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত স্থির হল। এখন প্রশ্ন হল, কখন থেকে শুরু হবে? তিনটি মতামত সামনে আসল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম থেকে, তাঁর হিজরতের সময় থেকে অথবা তাঁর ইনতেকালের সময় থেকে। হযরত উমর রা. সিদ্ধান্ত দিলেন, হিজরত থেকে বর্ষপঞ্জি বা ক্যালে-ারের সূচনা করা হবে। কেননা হিজরতের মাধ্যমেই হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্য-রেখা সূচিত হয়েছে। (দেখুন, আশ শামারীখ, পৃ. ১১)।
এটাই হিজরী নববর্ষের প্রসিদ্ধ ইতিহাস। তবে কোনো কোনো বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই হিজরতের সময় থেকে বর্ষ গণনা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লামা সুয়ূতী রহ. ইবনে শিহাব যুহরী রহ. সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেন, যা থেকে জানা যায় যে, সর্বপ্রথম স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরতের পর বর্ষ গণনা হিজরত থেকে করার আদেশ করেছিলেন। (আশ শামারীখ, পৃ.১৪)।
আল্লামা সুয়ূতী রহ. রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক চিঠি প্রেরণের কথাও উল্লেখ করেছেন, যাতে তাঁর পক্ষ থেকে ‘হিজরী পঞ্চম বর্ষ’ লেখানোর বিষয়টি প্রমাণিত রয়েছে। ( আশ শামারীখ, পৃ. ১২, তারীখে তাবারী ২/২৮৮)।
আল্লামা সুয়ূতী রহ.(মৃ.৯১১হি) বলেন, এ থেকে প্রমাণিত হয়, হিজরী সালের মূল প্রবর্তক রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হযরত উমর রা. তাঁর অনুসরণ করেন। (আশ শামারীখ ফী ইলমিত তারীখ, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতীকৃত, পৃ. ১২)।
আল্লামা সাখাবী রহ.ও (মৃ. ৯০২ হি.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আলই’লান বিত্তাওবীখ লিমান যাম্মাত তারীখ’ এ বিষয়ে অত্যন্ত গবেষণাধর্মী আলোচনা পেশ করেছেন। আগ্রহী পাঠকগণ তা দেখে নিতে পারেন।
সাহাবায়ে কেরাম পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরত থেকে ইসলামী বর্ষপঞ্জি শুরু করা হবে। প্রশ্ন উত্থাপিত হল, কোন মাস থেকে গণনা শুরু হবে? রবীউল আউয়াল মাসে যেহেতু হিজরত সংঘঠিত হয়েছিল, কেউ কেউ এ মাস দিয়ে হিজরী সালের সূচনা করার মত প্রকাশ করলেন। কেউ রমাযান মাসের ফযীলতের চিন্তা করে তার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু হযরত উসমান রা. এর মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হল। তিনি বললেন, মুর্হারম থেকে বর্ষপঞ্জি সূচনা করা হোক। এটি সম্মানিত মাস। এটিই বছরের প্রথম মাস। এমাসেই মানুষ হজ থেকে প্রত্যাবর্তন করে।
এভাবে ১৭ বা ১৮ হিজরিতে হিজরী সাল মুহাররম থেকে শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত স্থির হল। (আশ শামারীখ ফী ইলমিত তারীখ, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতীকৃত, পৃ. ১২)।
হিজরী নববর্ষের শিক্ষা
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, একজন ইতিহাস পাঠক ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য দুুটি-
এক.মানুষ ও কালের বিভিন্ন অবস্থা থেকে উপদেশ গ্রহণ করা ।
দুই.জাতীয় ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সম্পর্কে অবগত হয়ে তা ধারণ করার চেষ্টা করা।জাতীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আখলাক, আদাব, সামাজিক মূল্যবোধ , সামাজিক আচার-ব্যবহার , আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভবিষ্যতের ভাবনা ও অতীতের সম্পর্কও ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আল্লামা হাফেয সাখাবী রহ. (মৃ. ৯০২হি.) ‘আল ই’লান বিত্তাওবীখ লিমান যাম্মাত তারীখ’ নামক বিখ্যাত কিতাবে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আগ্রহী পাঠকগণ তা দেখে নিতে পারেন। (দেখুন: ‘আল ই’লান বিত্তাওবীখ লিমান যাম্মাত তারীখ’, হাফেয সাখাবীকৃত, পৃ. ৫০-৮০)।
তাই হিজরী নববর্ষের ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়েও আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরবর্তীতে হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. এর সামনে অতীতের বিভিন্ন জাতির বর্ষপঞ্জি থাকা সত্ত্বেও হিজরতের তারিখ থেকে মুসলমানদের বর্ষপঞ্জি সূচনা করার মধ্যে মুসলমানদের জন্য রয়েছে অনেক বড় শিক্ষণীয় বিষয়। কারণ হিজরত ইসলামী ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বইতিহাসেও এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এটি ছিল হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ণয়ের চুড়ান্ত দিন। এটি ছিল দীনের বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ ও বিসর্জনের সাহসী পদক্ষেপ।
মক্কার কাফের-মুশরিক কর্তৃক পাশবিক নির্যাতন, অব্যাহত অমানবিক আচরণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট ইত্যাদি সত্ত্বেও মুসলমান আপন দ্বীনের উপর অটল-অবিচল থাকেন। নীরবে সয়ে যান এসব অকথ্য জুলম-নির্যাতন। অবশেষে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্র মেতে উঠে। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলার হুকুমে মুসলমানগণ মদীনায় হিজরত করেন। এই ধৈর্য, ত্যাগ ও বিসর্জনের ফলেই মুসলমানগণ মদীনার মত বহুজাতিক রাষ্ট্রে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা ও তৎপরবর্তী সময়ে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসারের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিতে পেরেছিলেন, যা ইসলামী ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়ের সূচনা করে।
হিজরী নববর্ষ এসব কিছুর স্মারক। হিজরী নববর্ষ প্রতিটি বর্ষের সূচনাকালে মুসলমানদেরকে এ কথার জানান দেয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম যে ধৈর্য, ত্যাগ ও বিসর্জনের ফলে ইসলামের পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গরূপ দেখতে পেরেছিলেন, আমরা যদি আজও পৃথিবীর বুকে সেভাবে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তাহলে তাঁদের অনুসরণে আমাদেরকে ধৈর্য, ত্যাগ ও বিসর্জন দিতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/