।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।
মহান আল্লাহ সূরা মারইয়ামের ৭১-৭২ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-
وَ اِنۡ مِّنۡکُمۡ اِلَّا وَارِدُهَا ۚ کَانَ عَلٰی رَبِّکَ حَتۡمًا مَّقۡضِیًّا ﴿ۚ۷۱﴾ ثُمَّ نُنَجِّی الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا وَّ نَذَرُ الظّٰلِمِیۡنَ فِیۡهَا جِثِیًّا ﴿۷۲﴾
তরজমা: (৭১) আর তোমাদের প্রত্যেককেই তা (জাহান্নাম) অতিক্রম করতে হবে, এটি তোমার রবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। (৭২) তারপর আমি এদেরকে মুক্তি দেবো যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে। আর যালিমদেরকে আমি সেখানে রেখে দেবো নতজানু অবস্থায়।
তাফসীর: আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে মহান আল্লাহ পুলসিরাত নিয়ে আলোচনা করেছেন। পুলসিরাত শব্দটি ফারসি। এর অর্থ সেতু। অন্যদিকে আরবীতে ‘সীরাত’-এর অর্থ হলো- রাস্তা বা পথ। তবে ইসলামী পরিভাষায় পুলসিরাত হলো জাহান্নামের উপর স্থাপিত ব্রিজ বা পুল। জান্নাতে যাওয়ার জন্য এটি অতিক্রম ছাড়া উপায় নেই। বান্দারা তাদের আমল অনুসারে পুলসিরাত পার হবে। পুলসিরাত পার হওয়ার সময় যারা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে যাবে, তাদের পার হওয়ার গতির মধ্যে কম বেশি থাকবে। (অর্থাৎ আমল অনুযায়ী কেউ দ্রুত বেগে আর কেউ মন্থর গতিতে পার হবে)।
পুলসিরাতের রাস্তার দূরত্ব প্রত্যেক ব্যক্তির আমল অনুযায়ী হবে। যার ঈমান ও আমল যত মজবুত ও দৃঢ় হবে, তার জন্য পুলসিরাত অতিক্রমের সময় সেই অনুপাতে হবে।
যার আমল ভালো হবে তার জন্য কম ও দ্রুত গতির, আর যার আমল দুর্বল তার ততটুকুই দূরত্বের ও মন্থর গতির হবে। কেউ কেউ বিদ্যুৎ গতিতে মুহূর্তেই তা পার হয়ে যাবে। কেউ বাতাসের গতিতে পার হবে। কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে পার হবে। কেউ পায়ে হেঁটে চলার মতো গতিতে পার হবে। আবার কেউ তা পার হতে পারবে না; বরং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
কিয়ামতের দিন জাহান্নামের উপর নির্মিত পুলসিরাতের উপর দিয়ে সকল মানুষকে অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। যে সকল ঈমানদারের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাতের ফায়সালা করেছেন তারা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবেন এবং পুলসিরাত অতিক্রম করতে সক্ষম হবেন। আর কাফের, মুশরিক, নাস্তিক, মুনাফিক এবং যাদের ওপর জাহান্নামের আগুন অবধারিত হয়ে গেছে তারা পুলসিরাত অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়ে জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে।
পুলসিরাত কেমন হবে এবং তা অতিক্রমের সময় মানুষের অবস্থা কেমন হবে, তা বিবৃত হয়েছে, সহীহ বুখারীর দীর্ঘ এক বর্ণনায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ثُمَّ يُؤْتَى بِالْجَسْرِ فَيُجْعَلُ بَيْنَ ظَهْرَيْ جَهَنَّمَ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا الْجَسْرُ قَالَ مَدْحَضَةٌ مَزِلَّةٌ عَلَيْهِ خَطَاطِيفُ وَكَلاَلِيبُ وَحَسَكَةٌ مُفَلْطَحَةٌ لَهَا شَوْكَةٌ عُقَيْفَاءُ تَكُونُ بِنَجْدٍ يُقَالُ لَهَا السَّعْدَانُ الْمُؤْمِنُ عَلَيْهَا كَالطَّرْفِ وَكَالْبَرْقِ وَكَالرِّيحِ وَكَأَجَاوِيدِ الْخَيْلِ وَالرِّكَابِ فَنَاجٍ مُسَلَّمٌ وَنَاجٍ مَخْدُوشٌ وَمَكْدُوسٌ فِي نَارِ جَهَنَّمَ حَتَّى يَمُرَّ آخِرُهُمْ يُسْحَبُ سَحْبًا فَمَا أَنْتُمْ بِأَشَدَّ لِي مُنَاشَدَةً فِي الْحَقِّ قَدْ تَبَيَّنَ لَكُمْ مِنْ الْمُؤْمِنِ يَوْمَئِذٍ لِلْجَبَّارِ وَإِذَا رَأَوْا أَنَّهُمْ قَدْ نَجَوْا فِي إِخْوَانِهِمْ
“এমন সময় জাহান্নামের উপর পুল স্থাপন করা হবে। সাহাবীগণ বললেন, সে পুলটি কেমন হবে হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, দুর্গম পিচ্ছিল স্থান। এর ওপর আংটা ও হুক থাকবে, শক্ত চওড়া উল্টো কাটা বিশিষ্ট হবে, যা নাজদের সাদান বৃক্ষের কাঁটার মতো হবে। সে পুলের উপর দিয়ে ঈমানদারগণের কেউ পার হয়ে যাবে চোখের পলক ফেলানোর মতো মুহূর্তে, কেউ বিদ্যুতের মতো, কেউ বাতাসের মতো আবার কেউ দ্রুতগামী ঘোড়সাওয়ারের মতো।
তবে মুক্তিপ্রাপ্তরা কেউ নিরাপদে চলে আসবেন, আবার কেউ জাহান্নামের আগুনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। একেবারে শেষে অতিক্রম করবে যে লোকটি সে হেঁচড়িয়ে কোনভাবে পার হয়ে আসবে।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
সহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
فَيَقُومُ فَيُؤْذَنُ لَهُ وَتُرْسَلُ الأَمَانَةُ وَالرَّحِمُ فَتَقُومَانِ جَنَبَتَىِ الصِّرَاطِ يَمِينًا وَشِمَالاً فَيَمُرُّ أَوَّلُكُمْ كَالْبَرْقِ ” . قَالَ قُلْتُ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي أَىُّ شَىْءٍ كَمَرِّ الْبَرْقِ قَالَ ” أَلَمْ تَرَوْا إِلَى الْبَرْقِ كَيْفَ يَمُرُّ وَيَرْجِعُ فِي طَرْفَةِ يْنٍ ثُمَّ كَمَرِّ الرِّيحِ ثُمَّ كَمَرِّ الطَّيْرِ وَشَدِّ الرِّجَالِ تَجْرِي بِهِمْ أَعْمَالُهُمْ وَنَبِيُّكُمْ قَائِمٌ عَلَى الصِّرَاطِ يَقُولُ رَبِّ سَلِّمْ سَلِّمْ حَتَّى تَعْجِزَ أَعْمَالُ الْعِبَادِ حَتَّى يَجِيءَ الرَّجُلُ فَلاَ يَسْتَطِيعُ السَّيْرَ إِلاَّ زَحْفًا – قَالَ – وَفِي حَافَتَىِ الصِّرَاطِ كَلاَلِيبُ مُعَلَّقَةٌ مَأْمُورَةٌ بِأَخْذِ مَنْ أُمِرَتْ بِهِ فَمَخْدُوشٌ نَاجٍ وَمَكْدُوسٌ فِي النَّارِ ” . وَالَّذِي نَفْسُ أَبِي هُرَيْرَةَ بِيَدِهِ إِنَّ قَعْرَ جَهَنَّمَ لَسَبْعُونَ خَرِيفًا .
তোমাদের প্রথম দলটি সীরাত বিদ্যুৎ গতিতে পার হয়ে যাবে। সাহাবী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার জন্য পিতা-মাতা উৎসর্গ হোক। আমাকে বলে দিন, বিদ্যুৎ গতির ন্যায় কথাটির অর্থ কী?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে কি কখনো দেখোনি? চোখের পলক ফেলার আগেই বিদ্যুৎ চমকানি মিলিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর পরবর্তী দলসমূহ যথাক্রমে বায়ুর বেগে, পাখির গতিতে, তারপর লম্বা দৌড়ের গতিতে পার হয়ে যাবে। প্রত্যেকেই তার আমল হিসাবে তা অতিক্রম করবে। আর তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে অবস্থায় সীরাতের উপর দাঁড়িয়ে এ দুআ করতে থাকবেন, হে আল্লাহ এদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিন।
এভাবে মানুষের আমল মানুষকে চলতে অক্ষম করে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা সীরাত অতিক্রম করতে থাকবে। শেষে এক ব্যক্তিকে দেখা যাবে, সে নিতম্বের উপর ভর করে পুলসীরাত অতিক্রম করছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, পুলসিরাতের উভয় পার্শ্বে ঝুলন্ত থাকবে কাঁটাযুক্ত লৌহ শলাকা। এরা আল্লাহর নির্দেশক্রমে চিহ্নিত পাপীদেরকে গেঁথে নিবে। তন্মধ্যে কাউকে তো ক্ষত-বিক্ষত করেই ছেড়ে দিবে, তারা নাজাত পাবে। আর কতকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে জাহান্নামের অতলে নিক্ষিপ্ত হবে।
হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেন, শপথ সে সত্তার যার হাতে আবু হুরায়রার প্রাণ, জেনে রেখো, জাহান্নামের গভীরতা সত্তর খারিফ (অর্থাৎ সত্তর হাজার বছরের পথ তুল্য)। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৩৭০)।
সর্বপ্রথম পুলসিরাত অতিক্রম করবেন আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তার উম্মত।
হাদিস শরীফে এসেছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
وَيُضْرَبُ الصِّرَاطُ بَيْنَ ظَهْرَيْ جَهَنَّمَ فَأَكُونُ أَنَا وَأُمَّتِي أَوَّلَ مَنْ يُجِيزُهَا وَلاَ يَتَكَلَّمُ يَوْمَئِذٍ إِلاَّ الرُّسُلُ وَدَعْوَى الرُّسُلِ يَوْمَئِذٍ اللهُمَّ سَلِّمْ سَلِّمْ
জাহান্নামের উপরে পুল প্রস্তুত করা হবে। আর আমি এবং আমার উম্মতই সর্বপ্রথম এই পুল অতিক্রম করবে। সেদিন রাসূলগণ ছাড়া আর কেউ কথা বলবে না। সেদিন রাসূলদের দোয়া থাকবে- হে আল্লাহ! রক্ষা করুন, রক্ষা করুন! রক্ষা করুন! (সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৭৪৩৭)।
প্রত্যেক মানুষকেই জান্নাতে যাওয়ার জন্য এ অন্ধকারাচ্ছন্ন ভয়াবহ পথ (পুলসিরাত) অতিক্রম করতে হবে। কারণ, সেটাই হবে জান্নাতে পৌঁছানোর একমাত্র পথ। প্রত্যেক মানুষই এ পুল অতিক্রম করার পরীক্ষার সম্মুখীন হবেন। যারা বিনা বাঁধায় তা অতিক্রম করতে পারবেন, তারাই সফল। কেননা পুলসিরাতের পরেই জান্নাতের অবস্থান।
আল্লাহ তাআলা পুলসিরাত অতিক্রমে মুত্তাকিদেরকে মুক্তি দেবেন। আর যারা সীমালঙ্ঘনকারী অত্যাচারী, তাদের অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবেন। ফলে তারা জাহান্নামে পতিত হবে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পুলসিরাত বিদ্যুতের গতিতে পার হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও সহযোগী পরিচালক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/