কিশোর মুঈন

পরিচালকের চিঠি

প্রিয় কিশোর বন্ধু!

আশা করি তোমরা সকলেই ভালো আছ। আমার এই চিঠি তোমরা যখন পড়বে, তখন হিজরি বর্ষপঞ্জির মাসটি হবে রবিউল আউয়াল। আজ থেকে হাজারো বছর পূর্বে এই মাসের ৯ তারিখ রোজ সোমবার পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, রহমাতুল লিল আলামীন বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এই ধরণিতে আগমন করেন। বিশ^নবীর আগমণ আমাদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় একটি নেয়মাত। যদি আল্লাহ তাআলা মহানবীকে না পাঠাতেন, তাহলে আমাদের কী অবস্থা হতো! আমরা মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়তাম, হিংস্রতার সাগরে ডুবে যেতাম। মানবতার ছিঁটেফোঁটা বলতে আমাদের মাঝে কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। নবীজি পৃথিবীতে এসেছেন, মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন বলেই তো আজ মানবতা সভ্যতার চূড়ায় পৌঁছেছে।

প্রিয় বন্ধুরা, মহান আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে একমাত্র যে  মহামানবকে আমাদের জন্য আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তিনি হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। আদর্শ হওয়ার জন্য যত গুণের প্রয়োজন, সবগুলো দিয়েই রাব্বুল আলামীন তাঁকে সাজিয়েছেন। তাইতো আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তোমাদের জন্য রয়েছে নবীজির মাঝে উত্তম আদর্শ। (আহযাব- ২১)

নবীজিই আমাদের আদর্শ, আমাদের মডেল, আমাদের প্রেম-ভালোবাসা ও আমাদের অনুপ্রেরণা। তাঁর অনুসরণের মাঝেই নিহিত রয়েছে আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা ও সফলতা। নবীজির আদর্শ বুকে ধারণ করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই তাঁর সীরাত পড়তে হবে। আয়োজন করতে হবে সীরাতের পাঠচক্র ও আলোচনা সভা। পুরো বছরজুড়ে সীরাত পড়ার সুযোগ না হলেও কমপক্ষে এই মাসেই আমরা সীরাতের একটি বই পড়তে পারি। যেখান থেকে আমরা নবীজির পুরো জীবন-বৃত্তান্ত, আচার-আচরণ ও চরিত্র সম্পর্কে অবগত হবো। সীরাত বিষয়ক বই পড়ার পর আমরা প্রত্যেকেই স্কুলে, মাদ্রাসায় কিংবা গল্পের আড্ডায় সীরাত নিয়ে আলোচনা করবো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধ্যয়নের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিবো। এভাবেই নবীজির ভালোবাসা ও তাঁর আদর্শ আমাদের জীবনে উদ্ভাসিত হবে। সুতরাং এই চিঠি পড়ার পর থেকে দেরি না করে আমরা দ্রুতই সীরাত-পাঠ কর্মসূচী বাস্তবায়ন শুরু করে দিবো। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি শ্বাস-নিশ্বাসে নবীজির সুন্নাহ ও সীরাতের উপর চলার তাওফীক দান করুন।

ইতি- তোমাদের পরিচালক ভাইয়া।

শিশু-কিশোর সীরাত চর্চা

সুন্দর জীবন গড়তে, হৃদয় জগত আলোকিত করতে, জীবনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে, নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নতির জন্য সীরাত পাঠের বিকল্প নেই। সীরাত পাঠ একজন মানুষের দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করে। একটি সুন্দর সফল জীবন গঠনে সীরাত পাঠের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এখানে আমরা শিশু কিশোরদের সীরাত পাঠের উপযোগী কিছু বই নিয়ে আলোচনা করবো ।

বাংলা ভাষায় শিশু কিশোরদের জন্য সীরাতের অসংখ্য মৌলিক ও অনুদিত বই রয়েছে। তন্মধ্যে শিশুদের সবচেয়ে সুন্দর ও উপযোগী বই হচ্ছে, মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ হাফি. এর “শিশু সীরাত” সিরিজ। সহজ ও সাবলীল ভাষায়, শিশু কিশোরদের জন্য চমৎকার একটি সীরাত সংকলন। একজন শিশু পাঠক মাত্রই বইটা পড়ে মুগ্ধ ও অবাক না হয়ে পারবে না। শব্দ ও সম্বোধনগুলো বেশ মনোহর এবং আকর্ষণীয়। বইটি মূলত সিরিজ আকারে মোট দশ খন্ডে লিখিত।  ১. মক্কায় নবীজি (সা.)। ২. মদিনায় রাসূলুল্লাহ (সা.)। ৩. জিহাদের ময়দানে রাসূলুল্লাহ (সা.) এটি দুই খন্ডে। ৫. নবীজি (সা.) এমন ছিলেন। এটিও দুই খন্ডে। ৭. শিশুদের প্রতি নবীজি (সা.)এর ভালোবাসা। ৮. নবিজী (সা.)এর মোজেযা। ৯. নবীজি (সা.) বলেছেন। ১০. তুমি না এলে।

দুই. গল্পে আঁকা সীরাত। এটিও শিশু-কিশোর উপযোগী করে লেখা। এর মূল লেখক শায়খ আবদুত তাওয়াব ইউসুফ। বাংলায় রূপান্তর করেন, শায়খ ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী হাফি.। এটি কোনো ইতিহাসগ্রন্থ নয়, কিংবা তথ্য ও তত্ত্বের ভারে ন্যুব্জ কোনো গবেষণাগ্রন্তও নয়; বরং বইটি হলো প্রিয় নবীজি (সা.)এর জীবনের উপর আলো জ্বলমলে একটি উপস্থাপনা।

নির্ঝর প্রবাহের মতো ঝরঝরে গদ্যে প্রিয়নবী (সা.)এর জীবনকে চিত্রিত করা হয়েছে চিত্তাকর্ষক গল্পের মায়াবী ভাষায়। এই বইটি শিশুসাহিত্যের এক অভিনব, পুলক- জাগানিয়া, প্রাণ-মাতানিয়া বিস্ময়কর সৃষ্টি, পড়তে শুরু করলে মনে হবে এই যে আমি  আমার নবীকে ভালোবাসার মসৃণ পথ ধরে কী সুন্দর এগিয়ে চলেছি।!

শায়খ ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভীর হাফি. আরও একটি বই আছে। শিশু কিশোর সীরাতুন্নবী স. নামে। এটাও সিরিজ আকারে লিখিত। মোট দশ খন্ডে। নবীজি (সা.)এর জন্ম থেকে ওফাত পর্যন্ত সুন্দর সাবলীল ভাষায় সিরাতের   আলোচনা করা হয়েছে।

তিন. নবী জীবনের গল্প-ভাষ্য মুস্তফা। লেখক নকীব মাহমুদ। বইটির পরতে পরতে ফুটে উঠেছে নবীপ্রেম, ভক্তি ও ভালোবাসা। একথা খুব জোরালোভাবে বলতে পারি, ছোটদের জন্য বাংলাভাষায়  লেখা এক অনন্য, অসাধারণ সীরাতগ্রন্থ।

সাগীর আহমদ

শিশুদের প্রতি নবীজির স্নেহ

নবীজির পবিত্র জীবনে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য অনুসরণীয় দিক রয়েছে। নবীজি (সা.)এর বরকতময় জীবন শিশুদের স্নেহ ও ভালবাসার অবিস্মরণীয় ঘটনায় ভরপুর। নবিজী শিশুদের ভালোবাসতেন এবং তাদের স্নেহ করতেন। স্নেহ ও ভালোবাসার টানে রাস্তা দিয়ে চলার সময় শিশুদেরকে সালাম দিতেন।

সাহাবী আবু কাতাদা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, আমি নামায পড়াতে দাঁড়ালে ইচ্ছে করি যে, দীর্ঘ করবো। কিন্তু কোনো বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনলে নামাজকে সংক্ষেপ করে ফেলি। (তার কান্নার কারণে)আমি তার মায়ের  কষ্টের কারণ হওয়াটা আমার অপছন্দনীয় হওয়ার কারণে। (সহীহ বুখারী) আবু কাতাদা আনসারী (রাযি.) বর্ণনা করেন যে, নবীজি নামায পড়া অবস্থায় নিজ নাতনী উমামাহকে পিঠের উপর ওঠাতেন।

যখন সিজদা করতেন তখন নামিয়ে দিতেন। এর নামাযরত অবস্থায় নিজেই চড়ে উঠত এবং নিজেই নেমে যেত। যেমনটা বাচ্চাদের অভ্যাস।) (বুখারী শরীফ) উল্লিখিত বর্ণনা সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, শিশুদের ভালোবাসা ও স্নেহ নবীজির পবিত্র সত্তার শিরা-উপশিরায় মিশে ছিল।

নবী করীম (সা.) সন্তানদের সুন্দর ও প্রিয় নাম রাখার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি সন্তানদের নাম যেন ভালো ও অর্থবোধক হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন। হযরত আলী (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, যখন হযরত হাসান  জন্মগ্রহণ করলেন তখন আমি তার নাম রাখলাম “হারব”। কিন্তু নবীজি (সা.) বললেন যে, না। তার নাম “হাসান”। অতঃপর যখন হুসাইন জন্ম লাভ করলেন তখন নবীজি (সা.) নাম জিজ্ঞাসা করলে আমি আবার সেই “হারব” নামটা বলি। তিনি বলেন, না। তার নাম “হুসাইন”।

আরও পড়তে পারেন-

এরপর আলী বলেন আমি তৃতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার নাম “হারব” রাখতে চাইলে তিনি বলেন, না। তার নাম “মুহসিন”। (আসসুনানুল কুবরা, হাদীস, ৬০-৭১১) । নবিজী হযরত হাসান-হুসাইনের সাথে খেলা করতেন। তাদের হাত ধরে বক্ষে তুলে নিতেন এবং তাদের চুম্বন করতেন। এমনও হতো যে, তিনি তাদেরকে পবিত্র পৃষ্ঠে তুলে বলতেন যে, তোমাদের আরোহণ কতই না উত্তম আরোহণ এবং তোমরা কতই না উত্তম আরোহী! (তাবরানী, হাদীস, ৬৬২)।

মা-বাবার কাছে নিজ সন্তানদের ভালোবাসা ও মায়া-মমতা অবশ্যই থাকে। নির্মম স্বভাবের পিতা এমনও আছে যারা নিজেদের আত্মপ্রেম, স্বীয় সাধিত ভাব ও গম্ভীরতায় নিমজ্জিত হয়ে নিজ সন্তানের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার হয়তো সুযোগেই পায় না। অথবা সেটাকে নিজের বড়ত্বের ক্ষতিকারক মনে করে বসে। এটাতো নিজের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, অন্যের সন্তানের ক্ষেত্রে তো একেবারে নিষ্ঠুর। কোথাও কোন শিশু দৃষ্টিগোচর হয়ে গেলে বড় তির্যকতা ও কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার অন্তরে ভীতি সঞ্চার করতে চায়। এজন্যই তো নবী করীম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদেরকে স্নেহ করবে না সে আমাদের (উম্মত) থেকে নয়। (তিরমিযী)

আব্দুল্লাহ বিন হারেস বলেন যে, রাসূল (সা.) হযরত আব্বাস এর তিন ছেলে আব্দুল্লাহ ওবায়দুল্লাহ এবং কাছিরকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে বলতেন, যে সবার আগে আসতে পারবে সে এটা এটা পাবে। সুতরাং তারা দৌঁড়ে এসে কেউ নবীজির পিঠে পড়তো আবার কেউ সিনা মুবারকে পড়তো। নবীজি (সা.) তাদেরকে সোহাগ করতেন এবং নিজের শরীরের সাথে স্পর্শ করাতেন। (মুসনাদে আহমদ বিন হাম্বল-৬,৩৮১)

হযরত জাবের বিন সামুরা বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল (সা.) এর সাথে যোহরের নামাজ পড়েছি। নামাজ শেষে নবীজি বাড়ির পথে রওনা হলেন। আমিও তার সাথে বের হলাম। তখন সামনে দিয়ে কয়েকজন শিশু আসলে, তিনি তাদের প্রত্যেকের চেহারায় হাত বুলিয়ে দিলেন। জাবের বলেন, নবীজি আমার চেহারায়ও হাত বুলিয়ে দিলেন। তখন আমি নবীজি   (সা.)এর   হাত মোবারকে শিথীলতা ও সুঘ্রাণ অনুভব করলাম, যেন তিনি আতরের বাটি থেকে হাত বের করলেন। (সহীহ মুসলিম) ।

অনেক সময় সাহাবায়ে কেরাম, শিশুদের সাথে নবীজির স্নেহ ও ভালবাসার আচরণ এবং কৌতুক ও রসিকতা দেখে মুগ্ধ হতেন যে, নবীজি এত বড় ব্যক্তিত্ব এবং রেসালাতের আসনে অধিষ্ঠিত  হওয়া সত্ত্বেও শিশুদের সাথে এ পরিমাণ মায়া-মমতার আচরণ করছেন, বিশ্ব ইতিহাস তার দৃষ্টান্ত পেশ করতে অক্ষম।

রাসূলুল্লাহ(সা.)এর ধারাবাহিক কর্মব্যস্ততা ও অগণিত দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও স্বীয় বরকতময় জীবনকে যে সৌন্দর্য ও ঔজ্জল্যের সাথে অতিবাহিত করেছেন। মানবধারা যতদিন বহাল থাকবে শিশুদের সাথে তার ভালোবাসা ও অনুগ্রহের সেই পূর্ণাঙ্গ নমুনা হেদায়তের প্রদীপ হয়ে চমকাতে থাকবে।

মুহাম্মদ আব্দুর রাউফ

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।