বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু ও দৈনন্দিন জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করে থাকেন। আজকের শিশু দেশের আগামী দিনের ভবিষ্যত নাগরিক ও কর্ণধার। যে কারণে শিশুদের নৈতিক ও মানবিক মান বিকাশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে থাকে দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার। আর শৈশবকালই ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার উপযুক্ত সময়।
কিন্তু হতাশার সাথে বলতে হচ্ছে, দেশে নতুন শিক্ষাক্রমের চূড়ান্ত রূপরেখায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ধর্মশিক্ষা আবশ্যিক বিষয় হিসেবে উপেক্ষিত হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে আগে যা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া বর্তমান শিক্ষাক্রমে নার্সারি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা ইতোমধ্যে বাদ দেয়া হয়েছে। এভাবে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা বিদায় নিচ্ছে। এতে করে ধর্মপ্রাণ মানুষ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত।
দেশের জনগণের আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে, ধর্মবিমুখ ও নৈতিকতাহীন নাগরিক তৈরির জন্য মূলত প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ধর্মশিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে বাদ দিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। এর ফলে অনৈতিকতা ও অপকর্মের জোয়ার আরো বেগবান হবে। দেশ সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া,ব্যভিচার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে ভরে যাবে এবং সমাজের সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও সহনশীলতা আরো বিনষ্ট ও অধঃপতিত হবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ‘ইসলামী শিক্ষা’ বাদ দেয়া দেশের ৯২ ভাগ মুসলমানের ধর্মীয় আবেগ ও বিশ্বাসের প্রতি গভীর উপেক্ষার শামিল। পাশাপাশি ইসলাম ধর্মের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণও বটে। একদিকে শিক্ষামন্ত্রণালয় ইসলামী শিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয় থেকে বাদ দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে, অপরদিকে এতে করে সমাজে অপসংস্কৃতি, ভোগবাদিতা, অনৈতিকতা, অনৈসলামিক আচরণের চর্চা বেড়ে যাওয়া, কিশোর গ্যাং কালচারের উৎপাত ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তার এবং ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যা প্রবণতা, সামাজিক অস্থিরতা ও অশান্তির পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে বলে সচেতন মানুষ মনে করেন। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে এভাবে ধর্মবিমুখ করে তোলায় শুধু ধর্মপ্রাণ মানুষই উদ্বিগ্ন নন, বরং দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্যও কখনো সহায়ক হচ্ছে না।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ একটি বিপুল মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ কথাটি লেখা আছে। এসব বিবেচনায় পাঠ্যবই থেকে ইসলাম শিক্ষা আবশ্যিক বিষয় থেকে বাদ দেয়া একেবারেই অযৌক্তিক এবং সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
স্রষ্টায় ভীতি না থাকলে আমানতের খিয়ানত করে, অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথে জড়িয়ে পড়ে মানুষ। অসৎ নাগরিক শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে বিরাট বাধা। অপরদিকে, ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা দৈহিক, মানসিক বিকাশ ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। সুশৃঙ্খল জীবন গড়ে ওঠে। উৎপাদনশীল ও দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়, যা একটি দেশ ও জাতির উন্নতি-অগ্রগতিতে খুব প্রয়োজন। তা ছাড়া ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। একই সাথে পরমত সহিষ্ণুতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ শেখায়। ফলে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি বিদ্যমান থাকে।
সব ধর্মে ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘পড়ো! তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’। (সূরা আলাক)। মহান রব এ আয়াতে জ্ঞানার্জনের কথা বলেছেন। যে জ্ঞানার্জন করলে মহান আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে জানা যাবে। আর এ ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে উপহার দিতে পারে একদল সৎ, যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্ব। ইতিহাসের সব যুগে একশ্রেণির সৎ, দক্ষ, যোগ্য লোকের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা দেশ, সমাজ এমনভাবে পরিচালনা করেছেন যেখানে দুর্নীতি-অনিয়ম, অন্যায়-অবিচার ছিল না। আর এটি সম্ভব হয়েছিল ধর্মীয় শিক্ষার ফলে। আজো সমাজ পরিবর্তনে প্রয়োজন সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্ব। দেশ-জাতির সঠিক নেতৃত্ব যথাযথভাবে গড়ে ওঠে ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে। তাই শিক্ষার সব পরিমণ্ডলে আদর্শবান ব্যক্তিদের জীবন চরিত্র পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও অন্যান্য নবীর জীবনাদর্শ এবং অন্যান্য ধর্মের জন্য তাদের ধর্মের মহান ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ পাঠ্যপুস্তকে রাখতে হবে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বেকারত্ব, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আয়-বৈষম্য ও পর্ণোগ্রাফির বিষাক্ত ছোবলে দিশেহারা। এ অবস্থায় কোমলমতি শিশুদের প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া অপরিহার্য। এটি দেশের প্রতিটা মানুষের প্রাণের দাবি। তাই আমরা প্রাক-প্রাথমিক থেকে সব স্তরে ধর্মীয়শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে এবং ইংরেজির মতো আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আরবি ভাষাকে পাঠ্য হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। যাতে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় বলীয়ান হয়ে আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিকে পরিণত হতে পারে। বর্তমান সরকার কী রেখে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে সেটা আলোচনায় আসবেই। কাজেই, সরকারকে এমন কিছু রেখে যেতে হবে, ভবিষ্যত প্রজন্ম যা সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করবে।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/