।। রাকিবুল হাসান ।।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেপ বোরেল তরুণ কূটনীতিকদের এক প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানে হচ্ছে তিনি সর্ব-ইউরোপিয়ান প্রতিনিধি, সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের নয়। তরুণ কূটনীতিকদের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন নিশ্চয়ই। সেখানে বলছিলেন, ‘হ্যাঁ, ইউরোপ হচ্ছে বাগিচা। এই বাগিচা আমরা সাজিয়েছি। এখানে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর সামাজিক সংহতির সর্বোত্তম সমন্বয় আমরাই করেছি। মানবসভ্যতার ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ। কিন্তু অবশিষ্ট পৃথিবী জঙ্গল। জঙ্গল বাগান খেয়ে ফেলতে পারে, বাগান জঙ্গল ধ্বংস করতে পারে না। তাই বাগিচা নিজেকে রক্ষা করতে হলে সে জঙ্গলে যেতে হবে। একে বাগিচায় পরিণত করতে হবে। ইউরোপিয়ানরা বাকি পৃথিবীকে শিক্ষা দিতে হবে। নয়ত তারা আমাদেরকে কোনো না কোনোভাবে ধ্বংস করে দিবে’।
যদি ১৬ শতকের কোনো ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন, একুশ শতকে এসেও শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্ববাদিতার প্রেতাত্মা আধুনিক ইউরোপের কেন্দ্রে হাজির, তা দেখে নিশ্চয়ই পুলক অনুভব করতেন। বোরেল হুবহু সেই যুক্তিগুলোই আওড়াচ্ছিলো যেগুলো আওড়ে ইউরোপিয়ান স্কলাররা সারা পৃথিবীর দখল ও লুণ্ঠনকে বৈধতা দিয়েছিল। ইউরোপের ইসলামবিদ্বেষ নতুন কিছু নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা যে মাত্রায় পৌঁছেছে, ক্রুসেড-উত্তর সময়ে যার নজির দেখা যায়নি।
এতদিন দাবি করা হতো ইসলামবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড মূলত অনুদার (নন-লিবারেল) রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট সংগ্রহের চাল। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইসলামোফোবিয়া রিপোর্ট ২০২১ বলছে ভিন্ন কথা। এতে দেখা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক এবং ফ্রান্সে লিবারেল ডেমোক্রেটিক দলগুলোই ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষ প্রচারে কাজ করে যাচ্ছে। ইউরোপের ২৭ টি দেশের মোট ৩৫ জন স্কলার ও পণ্ডিতের অংশগ্রহণে রিপোর্টটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
ইসলামফোবিয়া সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে। দাবি করা হয় এই দুটিই ইউরোপের আলোকবর্তিকা। আধুনিকতার সূতিকাগার। ফ্রান্স নাকি সবসময় অবশিষ্ট ইউরোপ থেকে কয়েক দশক এগিয়ে থাকে। সেই ফ্রান্সে কাতার বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে খব ঈধহধৎফ বহপযধরহল্ক ম্যাগাজিন একটি সমালোচনামূলক সংখ্যা বের করেছে। অক্টোবর-’২২ সংখ্যার কভার পেজে কাতার বিশ্বকাপ দলের কার্টুন অঙ্কিত। লম্বা চুলওয়ালা, রাগি রাগি চেহারার খেলোয়ারদের কারো হাতে লম্বা চাকু, কারো হাতে মেশিনগান, মুখোশধারী একজনের কাঁধে রকেট লঞ্চার!
আরও পড়তে পারেন-
- কওমি মাদ্রাসা: সামাজিক পুঁজি ও দারিদ্র্য বিমোচন
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
- সুখময় দাম্পত্য জীবনের নববী রূপরেখা
ঠিক আজ থেকে বিশ বছর আগে ওয়ার অন টেররে যে ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছিল, হুবহু সেটাই। অথচ গোটা পৃথিবী জানে ওয়ার অন টেররের বরকন্দাজরা এখন পরাজিত শক্তি। যত ফ্রন্টে গিয়েছিল, সবগুলো থেকে নাকে খত দিয়ে চরম লাঞ্চিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ইরাক-আফগানিস্তানে ওয়ার অন টেরর হয়নি, বরং ওয়ার অন টেররের কবরস্থানে পরিণত হয়েছে এবং সেই মার এতটাই তীব্র ছিল যে এখন ওয়ার অন টেরর তো বহুদূর, সামান্য জিওপলিটিক্যাল হিসাব-নিকাশ করতে বসলেও আগে মাথায় থাকে মারের চিন্তা।
সিরিয়ায় কী করবে কী করবে না সেই হিসাব মিলাতে মিলাতেই আমেরিকা আর ন্যাটোর সময় শেষ। যতক্ষণে অবশ্য হিশাবকিতাব শেষ হয়েছে ততদিনে রাশিয়া সিরিয়ায় কর্তৃত্ব শক্ত করে ফেলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- যে সত্যটা গোটা পৃথিবী জানে, যে প্রজেক্টের ব্যর্থতা সারা দুনিয়ায় চাউর, সেটা কী ইউরোপ থেকে দশক দশক এগিয়ে থাকা ফ্রান্স জানে না? অবশ্যই জানে। কিন্তু জানা সত্ত্বেও নিজেদের ইসলামবিদ্বেষ চরিতার্থ করতে ব্যর্থ প্রজেক্টের শরণ নিতেও বাধা নেই।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট শরণার্থী স্রোত আশ্রয় দিতে ইউরোপের সবচেয়ে জেনোফোবিক (বিদেশিবিদ্বেষী) রাষ্ট্রগুলোর একটি পোল্যান্ডও দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পোল্যান্ড এখন প্রতিটি পরিবারে একটি করে ইউক্রেনীয় পরিবারকে আশ্রয় দিচ্ছে। যে রাশিয়ার আক্রমনে ইউক্রেনীয়রা ঘরবাড়ি ছেড়ে আসছে, ঠিক সেই রাশিয়ার আক্রমণেই সিরিয়ানরাও ঘর ছেড়েছিল। কিন্তু ইউরোপিয়ানদের দরজা তাদের জন্য খোলেনি।
হার্ভার্ড পাবলিকেশনের প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে ২০২২ সালের একটি গবেষণায় ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাবমিটকৃত চার হাজার আশ্রয় আবেদন যাচাই করে দেখা হয়। গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে- মুসলিমরা আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা খ্রীস্টানদের চেয়ে অনেক কম। এখানে মনে রাখতে হবে ইউরোপ নিজেকে সেক্যুলার ও লিবারেল হিসেবে দাবি করে থাকে। এই আচরণ সৌদি সরকার করলে সমস্যা ছিল না। কারণ তারা বলেকয়ে ধার্মিক রাষ্ট্র। ইউরোপিয়ানদের দাবি মতে তারা ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করে না। দুনিয়ার সমস্ত মানুষ তাদের দৃষ্টিতে শুধুই মানুষ। তবে সম্ভবত মুসলিমরা বাদে।
হার্ভার্ডের রিপোর্ট এবং ইউরোপিয়ান ইসলামোফোবিয়া রিপোর্ট উভয়টিতে উঠে এসেছে যে শুধু সাধারণ জনগণ নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলামোফোবিয়া বিস্তৃত হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার ও চাকরির মতো একদম মৌলিক বিষয়গুলোতেও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইউরোপিয়ান ইসলামোফোবিয়া রিপোর্ট ২০২১ এ যেসব দেশের নাম তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে সেগুলো হলো- অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য। এর মধ্যে ২০২১ সালে ফ্রান্সে ২১৩ টি মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনা ঘটেছে। যার প্রায় অর্ধেক (১০৯টি) আক্রমণ ছিল মসজিদ, ইসলামি সেন্টার এবং মুসলিমদের কবরস্থানে!
শুধু একটু তুলনা করার জন্য বলি- আমাদের দেশে তো নাকি হিন্দুবিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদেশের মানুষ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, তাই তাদের মাঝে ভিন্ন ধর্মের প্রতি সহনশীলতা নেই। আমাদের দেশে বছরে কয়টা মন্দিরে আক্রমণের ঘটনা ঘটে? বিগত দশ বছরের মন্দির আক্রমণের ঘটনাগুলো একসাথে করলে সংখ্যাটা ১০০ তে যাবে? সম্ভবত ১০ এও যাবে না।
অনুরূপ, জার্মানিতে ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা ঘটেছে একবছরে মাত্র ৭৩২ টি! তন্মধ্যে ৫৪ টির টার্গেট ছিল মসজিদ। সুইডেনের মতো তথাকথিত অত্যন্ত উদার দেশে ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শুধু ধর্মীয় কারণে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ৯৯৬ টি! এবং ধর্ম, জাতীয়তা ও অন্যান্য কারণে সংঘটিত হেইটক্রাইমের সংখ্যা মাত্র ১৪৭১০টি (চৌদ্দহাজার সাতশত দশটি)!!
এটিই ইউরোপের প্রকৃত চেহারা। এবং সেই চেহারার কদর্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বোরেল যতই বাগিচাতত্ত্ব আওড়াক না কেন, সত্য সেটাই যা বলেছেন ডক্টর রামজি বারাউদ- দুঃখজনকভাবে, ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অধ্যায়গুলোর জন্মস্থান ইউরোপ। উপনিবেশবাদ, স্লেভারি, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিজম এবং নিহিলিস্টিক আন্দোলনসমূহ; যা বিগত তিন শতাব্দি ধরে পৃথিবীকে অস্থির করে রেখেছে’।
লেখক: তাকমিল; মাদরাসা বাইতুল উলুম, ঢালকানগর এবং শিক্ষার্থী; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/