প্রসঙ্গঃ দেওবন্দিয়্যাত ও ফিকরে দারুল উলূম

।। আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক ।।

দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পটভূমি

মুসলমান সুলতানগণ ভারতকে শিক্ষা-দীক্ষা, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, হস্তশিল্প ও ক্ষেত খামারের দিক দিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত ও শিক্ষা-সভ্যতায় পৃথিবীর কোনো দেশ ভারতের সমকক্ষ ছিল না। ইউরোপিয়ানরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকরি-নকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। কোনো ইউরোপিয়ান ভারত থেকে ইউরোপে যাওয়ার পর এলাকার লোকজন তাকে দেখতে আসতো। কারণ, সে ইন্ডিয়া থেকে কত যে টাকা-পয়সা নিয়ে এসেছে। ওই সময় ভারত ধন-সম্পদ, শিক্ষা-সভ্যতা, শান্তি ও নিরাপত্তার যে স্তরে আসীন ছিল, বর্তমান পৃথিবীতে কোনো দেশ ওই স্তরে পৌঁছতে পারেনি।

কিন্তু আঠারো শতাব্দীর গোড়ার দিকে বৃটিশরা ব্যবসার নামে ভারতে আসে। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, ধন-সম্পদে ভরপুর ভারতের প্রতি তাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। সিদ্ধান্ত নেয় তারা ভারত দখলের। তারা ছিল মানবরূপী প্রতারক এক ঝাঁক চোর-ডাকাতের দল। তারা যে কত নিকৃষ্ট প্রকৃতির ছিল, সভ্য ও উদারমনা ভারতবাসী তা বুঝতে পারেনি। তারা তাদের প্রতারণার মাধ্যমে মীর জাফরকে সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়, আর ১৭৫৭ সনে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলাহকে শহীদ করে বাংলা বিহার দখল করে। পঞ্চাশ-ষাট বছরে তারা পুরো ভারতবর্ষকে দখল করে নেয়।

মুসলমান বাদশাহগণ এদেশে এসে এখানে বিয়ে-শাদী করে এদেশেই স্থায়ীভাবে জীবন-যাপনের সিদ্ধান্ত নেন, তাই নিজের দেশের উন্নতির জন্য তারা যা করার তা শতভাগ করেছেন। কিন্তু পশ্চিমারা এদেশে এসে চুরি-ডাকাতি, লুট-তরাজ করে। হাজার হাজার মণ স্বর্ণ-রূপা, মূল্যবান পাথর, বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প ভারত থেকে জাহাজে করে বৃটেনে নিয়ে যায়। ধান, গম, ডাল, সরিষা ইত্যাদি মৌসুমি ফসল উঠার সাথে সাথে কম মূল্যে খরিদ করে হাজার হাজার জাহাজ বোঝাই করে তাদের দেশে নিয়ে যেত এবং চড়া মূল্যে বিভিন্ন দেশে তা বিক্রি করত।

মৌসুম শেষ হলে পুরো বছর বাজারে কোনো ধান গম মজুত না থাকায় দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত, অনাহারে এক এক বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেত। হযরত মাদানী রহ. নকশে হায়াতে এক ইংরেজের দেওয়া রিপোর্ট বর্ণনা করেন যে, ১৮৬০ থেকে ১৯১০ পর্যন্ত ৫০ বছরে ভারতে অনাহারে তিন কোটি মানুষ মারা যায়। অথচ বাদশাহী   আমলে  দেশের ফসল  দেশে  থাকার কারণে দেশের মানুষ ছাড়াও বিদেশি লোকজন সারা বছর ভারতের বাজার থেকে ধান, গম, ডাল, পিয়াজ, মরিচ ইত্যাদি খরিদ করতে আসত।

এই ডাকাতরা ভারত থেকে বাঁশ, পাট, ইক্ষু, তুলা ও লতাপাতা ইত্যাদি কাঁচামাল নিয়ে যেত এবং তাদের দেশে কাগজ, কাপড়, চিনি ও ঔষধ তৈরি করে তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্তগুলো আবার ভারতের বাজারে বিক্রি করে টাকাগুলো বৃটেনে নিয়ে যেত।

বিশ্ব বাজারে ভারতীয় কাপড় ছিল সর্বসেরা, কিন্তু কম্পানিগুলো আমাদের তাঁতগুলো নষ্ট করে দেয়। জমির চড়া খাজনা  ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্পের উপর চড়া ট্যাক্স বসিয়ে সব ক্ষুদ্র শিল্পগুলো খতম করে দেয়। তারা নবাব ও জমিদারদেরকে রাস্তার ভিখারিতে পরিণত করে। এই দুষ্টরা শুধু শোষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং স্থানীয়দের গরিব বানানোও তাদের আরেক উদ্দেশ্য ছিল।

শিক্ষা-দীক্ষায় স্পেন ছিল বিশ্বসেরা, স্পেনের পতনের পর ভারত ছিল শিক্ষা-দীক্ষায় পৃথিবীতে এক নম্বরে। শুধু বাংলায় ছোট বড় আশি হাজার মাদরাসা ছিল। দেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ জমি মাদরাসা মসজিদের নামে ওয়াকফ ছিল। বৃটিশ এসব সম্পত্তি দখল করে মাদরাসাগুলোকে বন্ধ করে দেয় এবং স্থানে স্থানে স্কুল খুলে ইংরেজী শিক্ষার সাথে সাথে খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষা দিতে আরম্ভ করে।

১৮৫৭ সালে সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর প্রায় চল্লিশ হাজার উলামায়ে কেরামসহ লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দেরকে তারা হত্যা করে। দিল্লী শহরের মহল্লায় মহল্লায় অভিযান চালিয়ে মুসলমানদেরকে চাঁদনী চকে নিয়ে আসা হতো এবং কয়েকশ’ লোককে সারিবদ্ধ করে কামান ফায়ার করে মেরে ফেলা হতো। কাউকে কুপিয়ে আবার কাউকে গরু-মহিষের কাঁচা চামড়া পেঁচিয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে শহীদ করা হতো। মহিলাদের সাথে অপকর্ম করে হাত পা বেঁধে স্তন কেটে মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে ফেলে রাখা হতো, এ অবস্থায় তারা মারা যেত, আবার কাউকে অপকর্মের পর লজ্জাস্থানে ছুরি ঢুকিয়ে শহীদ করে দিত।

বুযুর্গ আলেমদেরকে  কামানের  নলের  মাথায় বেঁধে কামান ফায়ার করা হতো, মাইল জুড়ে তাঁর শরীরের ক্ষত-বিক্ষত অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ত।

আলেম-উলামা জীবিত না থাকায় দেশে কুরআনের তালিম বন্ধ হয়ে যায়। পাড়া গাঁয়ে জানাযা পড়ানোর লোক পাওয়া যেত না। বৃটিশরা সিদ্ধান্ত নিলো, স্পেনের মতো সচেতন নাগরিকদেরকে হত্যা  অথবা দিপান্তর করা আর শিশুদেরকে স্কুলের শিক্ষার মাধ্যমে খ্রিষ্টান বানিয়ে ফেলার। এ অবস্থায় এক-দুই জেনারেশনের পর এ দেশে কোনো হিন্দু-মুসলিম থাকবে না, স্পেন পর্তুগালের মতো ভারতও এক খ্রিষ্ট দেশে পরিণত হবে।

এহেন অবস্থায় ভারতের ভেতরে বাইরে, হারামাইন শরীফাইনে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী ও হযরত আব্দুল গনী মুজাদ্দিদে মুহাজিরে মাদানীসহ হাজারো আওলিয়ার কান্নাকাটি ও দুআ “আল্লাহ তাআলা যেন হিন্দুস্থানে ইসলাম ও মুসলমানের হেফাযত করেন” আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের দুআ কবুল করেন এবং হযরত কাসিম নানুতবী রহ. মাওলানা যুলফিকার আলী, হাজী আবিদ হোসাইন ও মাওলানা ফযলুর রহমানের সহযোগিতায় দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদে ১৫ মুহাররাম ১২৮৩হি. ৩০ মে ১৮৬৬ইং তারিখে এক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত নানুতবী মোল্লা মাহমূদ (রহ.)কে ১৫ টাকা বেতন ধার্য করে উস্তাদ নিয়োগ দেন আর মাও. যুলফিকার আলী রহ. তার ছেলে মাহমূদকে ছাত্র নির্বাচন করেন।

মাদরাসা পরিচালনার আট মূলনীতি

এই এক উস্তাদ ও এক ছাত্র দুই মাহমূদ দ্বারা এই ইলহামী মাকতাবে ফিকর “দারুল উলূম” এর ইফতেতাহ করা হয়, ১৫ মুহাররাম ১২৮৩/৩০ মে ১৮৬৬ রোজ বৃহস্পতিবার দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদে।

হযরত কাসিম নানুতবী রহ. এর যে ৮ ইলহামী মূলনীতির উপর দারুল উলূম পরিচালিত হয়, তাহলো-

১. যথাসম্ভব মাদরাসার কর্মচারী ও কর্মকর্তাদেরকে অধিকহারে চাঁদা আদায়ের বিষয়টির প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। নিজেও এর জন্য চেষ্টা করতে হবে, অন্যের মাধ্যমেও চেষ্টা করাতে হবে। মাদরাসার হিতাকাঙ্খীদেরও এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।

২. যেভাবেই হোক মাদরাসার ছাত্রদের খানা চালু রাখতে হবে বরং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে হিতাকাঙ্খী ও কল্যাণকামীদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

৩. মাদরাসার উপদেষ্টাগণকে মাদরাসার উন্নতি, অগ্রগতি এবং সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার দিকে সর্বদা লক্ষ রাখতে হবে। নিজের মত প্রতিষ্ঠার একগুঁয়েমী যাতে কারো মাঝে না হয় এ দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। আল্লাহ না করুন যদি এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, উপদেষ্টাগণ নিজ নিজ মতের বিরোধিতা কিংবা অন্যের মতামতের সমর্থন করার বিষয়টি সহনশীলভাবে গ্রহণ করতে না পারেন তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূল নড়বড়ে  হয়ে  পড়বে।  আর  যথাসম্ভব মুক্ত মনে পরামর্শ দিতে হবে এবং মাদরাসার শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি লক্ষণীয় হতে হবে।  নিজের মত প্রতিষ্ঠার মনোবৃত্তি না থাকতে হবে। এ জন্য পরামর্শদাতাকে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তার মতামত গ্রহণীয় হওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই আশাবাদী না হতে হবে।

পক্ষান্তরে শ্রোতাদেরকে মুক্তমন ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তা  শুনতে হবে। অর্থাৎ এরূপ মনোবৃত্তি রাখতে হবে যে, যদি অন্যের মত যুক্তিযুক্ত ও বোধগম্য হয়, তাহলে নিজের মতের বিপরীত হলেও তা গ্রহণ করে নেওয়া হবে। আর মুহতামিম বা পরিচালকের জন্য পরামর্শসাপেক্ষে সম্পাদনীয় বিষয়ে উপদেষ্টাগণের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া অবশ্যই জরুরি। তবে মুহতামিম নিয়মিত উপদেষ্টাদের থেকেও পরামর্শ করতে পারবেন কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত এমন কোন বিদগ্ধ জ্ঞানী আলেম থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন, যিনি সকল দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের জন্য হিতাকাক্সক্ষী ও কল্যাণকামী। তবে যদি ঘটনাক্রমে উপদেষ্টা পরিষদের সকল সদস্যের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ না হয় এবং প্রয়োজনমাফিক উপদেষ্টা পরিষদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের সাথে পরামর্শক্রমে কাজ করে ফেলা হয়, তাহলে কেবল এ জন্য অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না যে, ‘আমার সাথে পরামর্শ করা হলো না কেন?’ কিন্তু যদি মুহতামিম কারো সঙ্গেই পরামর্শ না করেন, তাহলে অবশ্যই উপদেষ্টা পরিষদ আপত্তি করতে পারবে।

আরও পড়তে পারেন-

৪. মাদরাসার সকল শিক্ষককে অবশ্যই সমমনা ও একই চিন্তা চেতনার অনুসারী হতে হবে। সমকালীন (দুনিয়াদার) আলেমদের ন্যায় নিজ স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত না হতে হবে। আল্লাহ না করুন যদি কখনো এরূপ অবস্থা দেখা দেয়, তাহলে মাদরাসার জন্য এটি মোটেও কল্যাণকর হবে না।

৫. পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচি নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরবর্তীতে পরামর্শের ভিত্তিতে যে পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করা হবে, তা যাতে সমাপ্ত হয়; এই ভিত্তিতেই পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিষ্ঠান সুপ্রতিষ্ঠিতই হবে না, আর যদি হয়ও তবু তা ফায়দাজনক হবে না।

৬. এ প্রতিষ্ঠানের জন্য যতোদিন পর্যন্ত কোন স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে; ততোদিন পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার শর্তে তা এমনিভাবেই চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যদি স্থায়ী আয়ের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেমন কোন জায়গীর লাভ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিল ফ্যাক্টরী গড়ে তোলা কিংবা বিশ্বস্ত কোন আমীর উমারার অনুদানের অঙ্গীকার ইত্যাদি, তাহলে এরূপ মনে হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ভয় ও আশার দোদুল্যমান অবস্থা; যা মূলতঃ আল্লাহমুখী হওয়ার মূল পুঁজি, তা হাত ছাড়া হয়ে যাবে এবং গায়েবী সাহায্যের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। তদুপরি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কর্মচারীগণের মাঝে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও কলহ বিবাদ দেখা দিবে। বস্তুতঃ আয় আমদানি ও গৃহাদি নির্মাণের বিষয়ে অনেকটাই অনাড়ম্বরতা ও উপায় উপকরণহীন অবস্থা বহাল রাখার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।

৭. সরকার ও আমীর উমারাদের সংশ্লিষ্টতাও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে হচ্ছে।

৮. যথাসম্ভব এমন ব্যক্তিদের চাঁদাই প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক বরকতময় হবে বলে মনে হচ্ছে; যাদের চাঁদাদানের মাধ্যমে সুখ্যাতি লাভের প্রত্যাশা থাকবে না। বস্তুতঃ চাঁদাদাতাগণের নেক নিয়ত প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক স্থায়ীত্বের কারণ হবে বলে মনে হয়।

মাসলাকে দারুল উলূম দেওবন্দ

দারুল উলূম দেওবন্দে কোনো বিষয়ে বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি নেই। দারুল উলূম দেওবন্দ এক মাসলাকে ইতিদাল ও মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী দ্বীনের সামগ্রিক প্রোগ্রামের নাম।

তাঁদের কাছে ইলম ও মারিফাতের সংমিশ্রণ, বিবেক ও প্রেম ভালোবাসার সংমিশ্রণ, ইলমের সাথে চরিত্রের সংমিশ্রণ, মুজাহাদায়ে নফসের সাথে জিহাদের সংমিশ্রণ, দীনদারীর সাথে রাজনীতির সংমিশ্রণ, নুছুছের সাথে কিয়াসের সংমিশ্রণ, নির্জনতার সাথে স্বজনতার সংমিশ্রণ, ইবাদতের সাথে একত্ববাদের সংমিশ্রণ, আইনের সাথে হেকমতের সংমিশ্রণ, যাহিরের সাথে বাতিনের সংমিশ্রণ, কথার সাথে কাজের সংমিশ্রণ রয়েছে।

তাই ইলম ব্যতীত মারিফাত অর্জন ও মারিফাত ব্যতীত ইলম অর্জন দেওবন্দিয়্যাত নয়, ওহীর রাহনুমায়ী ছাড়া আল্লাহ ও রাসূলের প্রেম দেওবন্দিয়্যাত নয়, হুসনে আখলাক ব্যতীত ইলম অর্জন দেওবন্দিয়্যাত নয়, নুছূছের রাহনুমায়ী ও তাযকিয়া ব্যতীত জিহাদ দেওবন্দিয়্যাত নয়, দ্বীন ব্যতীত রাজনীতি যেভাবে দেওবন্দিয়্যাত নয়, ইসলামী রাজনীতিকে তিরস্কারও দেওবন্দিয়্যাত নয়, নস ছাড়া শুধু যুক্তির উপর চলা দেওবন্দিয়্যাত নয়। নির্জনতা ছাড়া শুধু স্বজনতা দেওবন্দিয়্যাত নয়। সামাজিকতা ব্যতীত শুধু ইবাদত আর ইবাদত ব্যতীত শুধু সামাজিকতা দেওবন্দিয়্যাত নয়। হিকমত ছাড়া শুধু আইন আর আইন ছাড়া শুধু হেকমত দেওবন্দিয়্যাত নয়, অন্তর খারাপ বাহির ভাল আর বাহির খারাপ অন্তর ভাল দেওবন্দিয়্যাত নয়, প্ল্যান প্রোগ্রাম সুন্দর কিন্তু কাজে নেই কিংবা শরয়ী কোনো প্রোগ্রাম নেই, শুধু ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা দেওবন্দিয়্যাত নয়, বিচক্ষণতা ব্যতীত শুধু আবেগ দেওবন্দিয়্যাত নয়।

২ যিলহজ্জ ১২৯২/ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫ ইং তারিখে দারুল উলূমের নিজস্ব ভবনের ভিত্তিস্থাপন করা হয়। ভিত্তিস্থাপনে এমন কয়জন আহলুল্লাহ ছিলেন যারা كأنك تراه এর ‘মাকামে শুহুদে’ উত্তীর্ণ ছিলেন, যারা ছগীরা গুনাহকে এভাবে খারাপ ও ক্ষতিকর মনে করতেন, যেভাবে সাধারণ উলামারা কুফরকে খারাপ ও ক্ষতিকর মনে করেন। তারা হলেন- মাওলানা আহমদ আলী সাহারানপুরী (রহ.) যিনি প্রথম ইট রাখেন, মাও. রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.), মাও. কাসিম নানুতুবী (রহ.), মাও. মাযহার নানুতবী (রহ.), মাও. মিয়াজী মুন্নে শাহ (রহ.) ও হাজী আবিদ হুসাইন (রহ.)। (সূত্র- তারিখে দারুল উলূম, ১/৪২৮)।

দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য

মাওলানা কারী তায়্যিব (রহ.), মুহতামিম দারুল উলূম দেওবন্দ বলেন-

১. কুরআন মাজীদ, তাফসীর, হাদীস, আকাইদ, ফিকাহ ও তার সম্পূরক বিষয়ের শিক্ষা দান করা। এবং মুসলমানদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

২. আমল ও আখলাকের তরবিয়্যাত এবং ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী স্প্রীট ও চেতনা সৃষ্টি করা।

৩. আলোচনা ও লেখার মাধ্যমে দ্বীনের হেফাযত, এশাআত ও বাতিল প্রতিরোধের চেষ্টা করা এবং সাধারণ মুসলমানদেরকে সালফে সালেহীনদের মতো আখলাক গঠনে আগ্রহী করে তোলা।

৪. সরকার থেকে দূরে থাকা এবং শিক্ষা ও চিন্তা চেতনা সবসময় স্বাধীন রাখা।

৫. দ্বীনি শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য সর্বত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা। (তারীখে দারুল উলূম, ১৪২)।

সারকথা, হযরত শায়খুল হিন্দের মতে এসব প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইলমে ওহীর হেফাযত ও মুসলমানদের অতীত ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করা দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। [চলবে]

লেখক: প্রবীণ আলেমে-দ্বীন, গবেষক ও শায়খুল হাদীস, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।