।। মুফতি আবদুল্লাহ নোমান ।।
প্রতিদিন কেউ না কেউ আসে মনোরম এই বসুন্ধরায়, আবার কেউ বেলা শেষে পরপারে পাড়ি জমায়। পৃথিবীর শুরু লগ্ন থেকে কেয়ামত অবধি এই ধারা চলমান। মৃত্যুর মাধ্যমেই দুনিয়ায় জীবনের সমাপনী আসে এবং আখিরাতের অনন্ত জীবনের সূচনা হয়। এ জীবন কিছু মুহূর্তের সমষ্টির নাম। এখানে দিন আসে, সন্ধ্যা নামে। আবার দেখা মেলে এক নতুন ভোরের। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভাঙে। আবার শুরু হয় জীবনের আরেকটি পাতা। এভাবে মাস কেটে যায়, বছর অতিবাহিত হয়। কেশে শুভ্রতা ধরে, শরীরে জীর্ণতা ও দুর্বলতা চেপে বসে। প্রতি মুহূর্তে এগোতে থাকি কবরের দিকে। অতীতের স্মৃতির পাতায় উঁকি দিলে মনে হয়, হাসি-কান্নার মিশেলে জীবনের প্রহরগুলো খুব দ্রুতই কেটে গেল। সময়গুলো যেন মুহূর্তেই ফুরিয়ে গেল। শৈশব, কৈশোর, যৌবন অতিবাহিত করে বার্ধক্যের সিঁড়িতে পা রাখলে অতিবাহিত জীবনটা রাতের ঘোরলাগা একটি স্বপ্নের মতোই মনে হয়। সবাই জানি, মানুষ মাত্রই মরণশীল। মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে আস্বাদন করতে হবে। রাব্বুল আলামিনের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-
كل نفس ذائقة الموت، ثم إلينا ترجعون.
অর্থাৎ- ‘প্রত্যেক জীবই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর আমারই নিকট তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে’। (সূরা আনকাবুত- ৫৭)।
এটা এক অনিবার্য বাস্তবতা। আমাদের মৃত আত্মাগুলোকে জাগ্রত করার জন্য এবং উদাসীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য মৃত্যুর স্মরণ অত্যন্ত কার্যকরী। মৃত্যুর স্মরণ মন-মনন থেকে হৃাস করে দেয় দীর্ঘ আশা-আকাক্সক্ষা। বাড়িয়ে দেয় নেক আমলের স্পৃহা। কেউ যদি সত্যান্বেষী হৃদয়ে উপদেশ গ্রহণ করতে চায় তবে মৃত্যুই তার জন্য শ্রেষ্ঠ উপদেশ, উত্তম নাসীহা, পাওয়ারফুল রিমাইন্ডার।
এ জীবন ক্ষণিকের
সন্দেহ নেই, দুনিয়া এক দুর্নিবার মোহের হাতছানি। এই মোহনীয় হাতছানির ইশারায় প্রলুব্ধ হয়ে মানুষ একসময় ভুলে যায় জীবনের লক্ষ্য। ভুলে যায় এই চিরন্তন সত্য কথাটিও যে, দুনিয়া তার চিরস্থায়ী কোন আবাস নয়, ক্ষণিকের পরবাসমাত্র। তাকে একদিন সব মায়া-প্রীতি-বন্ধন ছেড়ে চলে যেতে হবে না ফেরার দেশে। তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্নের সাজানো সংসার ত্যাগ করে পাড়ি জমাতে হবে তার অলঙ্ঘনীয় অন্তিম পাথারে। মানুষ জানে, একদিন সুশোভিত জীবনের শৃঙ্খল ভেঙে যাবে, থেমে যাবে সব রঙিন স্বপ্ন; ফিকে হয়ে যাবে সব মধুর সম্পর্ক। তবুও মানুষ ভালোবাসে মরীচিকাময় এ দুনিয়া। ভুলে যায় তার আসল ঠিকানা। মিছে এই দুনিয়ার পেছনে পাগলপারা মোহগ্রস্ত মানুষগুলো হঠাৎ মহাসত্যের মুখোমুখি হয়। আত্মসমর্পণ করে প্রস্থানের চিরন্তন নিয়মের কাছে, কাক্সিক্ষত পাথেয় বিহীন।
ভুলে গেলে চলবে না ফলে ফুলে সুশোভিত মনোরম এই বসুন্ধরা পরপারের স্রেফ একটি সেতু। এখানে খড়কুটো কুড়িয়ে আগলে রাখা নিতান্তই বোকামি। সুতরাং জীবিকার দৈন্যদশা, চলার পথের নানা সংকট ও বৈরিতা, অনাকাক্সিক্ষত যেকোনো পরিস্থিতিতে হৃদয়ের সন্তুষ্টি নিয়ে পথ চলাই শুভ বুদ্ধির পরিচয়। দুনিয়া হচ্ছে সাময়িক বিশ্রামাগার। আর আখিরাত হচ্ছে গন্তব্যস্থল। গন্তব্য ভুলে গেলে যেমন এক সীমাহীন কষ্টের ভবঘুরে জীবন বেছে নিতে হয়, তেমনি পরকালের আসল নিবাসকে স্মরণ না রাখলে সেখানে ভোগ করতে হবে অবর্ণনীয় শাস্তির এক অসহনীয় জীবন। আমাদের ৬০/৭০ বা ৮০/৯০ বছরের এ হায়াত আখেরাতের বিশাল অনন্তকালের তুলনায় সাগরের এক ফোটা জল ছাড়া বেশি কিছু নয়। বিশ্বনবী (সা.)বলেছেন, ‘দুনিয়া আখেরাতের তুলনায় এতটুকু, যেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রের পানিতে তার একটি আঙুল ডুবিয়ে তুলে আনল। সে দেখুক তারা আঙুলে কতটুকু পানি উঠেছে’। (তিরমিযী- ২৩২৩)।
মানুষের কাছে পরকালে দুনিয়ার জীবনটা কত সংক্ষিপ্ত মনে হবে- কুরআনুল কারিমে আল্লাহ পাক তা তুলে ধরেছেন এভাবে- আল্লাহ বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে বছরের গণনায় কত কাল থেকেছো? ওরা বলবে, আমরা একদিন অথবা একদিনেরও কম সময় থেকেছি! আপনি বর্ণনাকারীদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন। তিনি বলবেন, তোমরা স্বল্পকালই থেকেছ। কত ভালো হতো যদি তোমরা জানতে, বুঝতে। তোমরা কি মনে করেছিলে যে আমি তোমাদের অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?’ (মু’মিনূন- ১১২-১১৫)।
দুনিয়া পরকালের এয়ারপোর্ট
আচ্ছা, কেউ যদি ভিনদেশে পাড়ি জমানোর জন্য বিমানের অপেক্ষায় এয়ারপোর্টে অবস্থান করে। বিমানবন্দরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনোহর দৃশ্যেই যদি সে মজে যায়; এখানেই স্থায়ী বসতি করার দিবা স্বপ্নে বিভোর থাকে, তাহলে তা কত বড় বোকামি হবে, ভাবুন তো! কারণ, কিছুক্ষণ পরেই তো তার বিমানটি উড়াল দেবে অন্য দেশের উদ্দেশ্যে। আর সে সবকিছু পেছনে ফেলে পাড়ি জমাবে সেখানে। এ পার্থিব জীবনকেও স্থায়ী মনে করা এয়ারপোর্টকে নিজের গন্তব্য মনে করার মতোই। তাইতো বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু মহানবী (সা.) প্রিয় সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.)এর দু’ কাঁধে হাত রেখে বললেন-
كن في الدنيا كانك غريب أو عابر سبيل.
তুমি দুনিয়াতে থাকো যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী। আর ইবনে ওমর (রাযি.) বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের আর অপেক্ষা করো না এবং সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার আর অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার সময় তোমার পীড়িত অবস্থার জন্য প্রস্তুতি নাও। আর তোমার জীবিত অবস্থায় তোমার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নাও’। (বুখারী- ৬৪১৬)।
তিরমীযির বর্ণনায় এটাও আছে, নবীজি (সা.) তাকে বলেছেন, ‘তুমি নিজেকে কবরবাসীদের অন্তর্ভুক্ত মনে কর’। তিরমীযী- ২৩৩৩)।
কবি বড় চমৎকার বলেছেন-
يہاں ہم سب مسافر ہیں قبر آخر ٹھکانہ
کوئی آگے روانہ ہے کوئی پیچھے روانہ
আমরা সবাই মুসাফির, ক্ষণিকের এই দুনিয়ায় পরিশেষে যাত্রা মোদের, কবরের ঐ ঠিকানায়!
যাচ্ছে সেথায় আগে কেউ
কেউ আসছে পরে
একলা ঘরে থাকতে হবে
প্রিয় স্বজন ছেড়ে!
সবাই কবর পথের যাত্রী
প্রিয় বন্ধু, কল্পনার ডানায় ভর করে শৈশবের রঙিন মখমল দিনগুলোর দিকে একটু ফিরে তাকান তো! দেখবেন, আমাদের আশেপাশে তখন অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি এই পৃথিবীর বুকে বিচরণ করতো। তাদের অনেকেই আমাদের সাথে মসজিদে নামাযও আদায় করতো। বলুন তো, তারা আজ কোথায়? কোথায় আমাদের প্রিয় দাদা-দাদী, নানা-নানী, ছোটবেলায় যারা আমাদেরকে কোলে পিঠে বড় করেছেন! স্নেহ-মমতায় মুখে চুমু এঁকে দিতেন! আমাদেরকে নানা আদুরে শব্দে ডাকতেন! মুখে তুলে দিতেন নানা মুখরোচক খাবার! এখন কি আর তাদের মধুমাখা সেই ডাক শুনতে পাই? না তো। তারা আজ মসজিদের পাশে মাকবারায় কিংবা পুকুরপাড়ের ঐ কবরস্থানে। আমাদেরও ঠিকানা সেখানেই। মাটির নিচেই হবে আমাদের ঘর। সবাই একই পথের পথিক। কেউ চলে যায় আগে, কেউ আসে পরে।
আজকে যে ব্যক্তি মাইকে মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণা করছে, আগামীকাল হয়তো অন্য কেউ তার মৃত্যুর ঘোষণা করবে। আজকে যে ব্যক্তি প্রিয়জনের খাটিয়া বহন করছে, আগামীকাল হয়তো অন্যরা তার খাটিয়া বহন করবে। আজকে যে ব্যক্তি অন্যের লাশ দাফন করছে, কালকে হয়তো অন্য কেউ তার লাশ দাফন করবে। এমনকি ঘটছে না আমাদের চারপাশে? তীক্ত হলেও সত্য, মৃত্যুর কোন সিরিয়াল নেই। ছেলের কাঁধে যেমন উঠে পিতার লাশ তেমনি পিতার কাঁধেও ওঠে ছেলের লাশ। আমরা মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ালেও মৃত্যু ঠিক সময়ে এসে আমাদের পাকড়াও করবে। আর হাজির করবে আল্লাহর আদালতে। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা, আপনি বলুন, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পলায়ন করছ, তা অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাত করবে। এরপর তোমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতার নিকট। অনন্তর তিনি তোমাদেরকে তোমরা যা করতে তা জানিয়ে দেবেন। (সূরা জুমুআ- ৮)।
কবির ভাষায়-
মরণ থেকে যতই পালাও,
মরণ তোমায় লইবে ঘিরি,
যদিও সুদূর আকাশ পানে,
পালাও সেথায় লাগায় সিঁড়ি।
কে প্রকৃত বুদ্ধিমান?
পৃথিবীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত কত অসংখ্য মানুষকে কবরস্থ করা হয়েছে। অতঃপর তাদেরকে গিলে ফেলেছে জমিন। আমাদের অনেক অনুজও পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছে। বয়সে আমাদের অনেক ছোটও কবরস্থানে শুয়ে আছে। সেই একলা ঘরে পড়ে আছে আমাদের অনেক প্রিয়মুখও। হাত ধরাধরি করে যাদের সাথে আমরা পাড়ি দিয়েছি জীবনের দীর্ঘ পথ। পরস্পর শেয়ার করেছি সুখ দুঃখের অনেক গল্প। কিন্তু আশ্চর্য! আমরা এখনো উদাসীনতার সাথে দিনাতিপাত করছি। গা ভাসিয়ে দিয়েছি গড্ডালিকা প্রবাহে। স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের এ জীবন অপস্রিয়মান ছায়ার মতো। এই আছে এই নেই। বিদায় ঘণ্টা বেজে গেলেই এক মুহূর্তও এখানে থাকা যাবে না আর। ভালো-মন্দ সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। ছোট-বড় সবাইকেই মৃত্যুর পেয়ালায় চুমক দিতে হবে। পুণ্যের সুবাসে সুরভিত জীবনের যেমন সমাপ্তি ঘটবে তেমনি গুনাহের পঙ্কিলতায় জর্জরিত জীবনেরও অবসান ঘটবে। সেসব মহামান্য মনীষীগণও মৃত্যুবরণ করবেন, যারা দুনিয়াতে পরকালের পাথেয় যোগাড় করেছেন। আবার সেসব পাপিষ্ট হতভাগারাও মারা যাবে, যারা দুনিয়ার চাকচিক্যে রবকে ভুলে শুধুই করেছে ভোগ-বিলাস। প্রকৃত বুদ্ধিমান তো তারাই, যারা প্রস্তুতি নিয়েই কবরে যেতে পেরেছেন। আসল বোকা তো তারাই, যারা প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ পোকামাকড়ের ঘরে প্রস্থান করেছে। শাদ্দাদ ইবনু আওস (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সেই ব্যক্তি বুদ্ধিমান যে নিজের নাফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের জন্য কাজ করে। আর সেই ব্যক্তি নির্বোধ ও অক্ষম যে তার নাফসের দাবির অনুসরণ করে আর আল্লাহ তাআলার নিকটে বৃথা আশা পোষণ করে’। (সুনানে তিরমিযী- ২৪৫৯)।
বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর দৃষ্টিভঙ্গি
আমরা এমন এক পোস্ট মডার্ণ সমাজে বাস করি, যেখানে দুনিয়ার লাভ-লোকসানই মূখ্য। জাগতিক স্বার্থই যার শেষ কথা। পার্থিব ভোগ-বিলাসের ইঁদুর-দৌড় প্রতিযোগিতা এবং দিন-রাতের লাগামহীন কর্মযজ্ঞে মনে হয় যেন আজীবনের জন্য এই ধরাধমে বসবাসের টেন্ডার পেয়ে গেছে তারা। তাইতো যখন কেউ নাস্তিকমনা দুনিয়া পূজারী তথাকথিত কোন সেলিব্রেটিকে চিরস্থায়ী আখেরাতের প্রস্তুতি বিষয়ক নাসিহা করে, স্মরণ করিয়ে দেয় মৃত্যুর অনিবার্য বাস্তবতার কথা, তখন সেই সেক্যুলার ফিডব্যাক দেয় এভাবে ‘আরে ওসব রাখো, জীবনটা তো দু’দিনের। এই দু’দিনে লাইফটা মনের মতো এনজয় করতে দাও! চোখ দুটো বন্ধ হলেই তো সব শেষ। এ সুযোগ মিস হয়ে গেলে আর কী পাবো’। তাদের স্লোগান হয়- ‘খাও দাও ফুর্তি করো, ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকো।’ কিন্তু এক্ষেত্রে আখেরাতকামি মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি হয় এমন- রবের ভালোবাসায় দু’দিনের এ জীবনে হাসি-তামাশা, আমোদ-প্রমোদ না হয় সেক্রিফাইস করলাম। চোখ দুটো বন্ধ হলেই তো নতুন জীবনের শুরু। যা দুদিনের নয় আজীবনের। সেখানেই ফূর্তি করব অনন্তকাল। মনের চাহিদা পূরণ করব ইচ্ছেমতো। পবিত্র কুরআনের ভাষায়,
ولكم فيها ما تشتهي أنفسكم ولكم فيها ما تدعون.
সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা কিছু তোমরা প্রার্থনা করবে। (সূরা হা-মীম আস-সাজদা- ৩১)।
কবি কত হৃদয়ছোঁয়া ভাষায় বলেছেন-
آرزوئیں خون ہو یا حسرتيں پامال ہو
اب تو اس دل کو بنانا ہے تیرے قابل مجھے
কামনার নদীতে রক্ত ভাসুক,
বেদনার সাগরে উঠুক জোয়ার।
হৃদয় জমিনকে করতে আবাদ,
প্রস্তুত সদা এই বান্দা তোমার।
বিশ্বাস করুন, আল্লাহপ্রেমিক মুমিনের আলোকিত এ ভাবনা কেউ যদি লালন করতে পারে মন-মকুরে, আমৃত্যু শয়তান ও নফসের বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকারে মুষ্টিবদ্ধ হতে পারে, তার জীবনে আসে ছন্দ। আসে আমূল পরিবর্তন। তার জন্য গুনাহ ত্যাগ করা যেমন সহজ হয়ে যায় তেমনি হৃদয়কাননেও দোলা দিয়ে যায় অন্যরকম এক প্রশান্তি। রাশি রাশি করুণার বারিধারায় সিক্ত হয় তার জীবনের প্রতিটি ক্ষণ। হ্যাঁ, এটাই বাস্তব। পরীক্ষা করে দেখুন না প্লীজ!
দম ফুরালেই সব শেষ
স্বাদের এ জীবন একটি সুযোগ মাত্র। এ সুযোগ পাপাচার বিসর্জন দিয়ে রবের দিকে ফিরে আসার। এ সুযোগ কবরের পাথেয় সঞ্চয় করে জান্নাতের টিকিট বুকিং করার। মৃত্যুদূত আসার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাবে এ চান্স। মৃত্যু কেড়ে নেবে সকল পদ ও ঐশ্বর্য। ভেঙে দেবে ভালোবাসার সব বন্ধন। ভুলিয়ে দেবে জমকালো সব আয়োজন। মৃত্যু মানেই হলো পৃথিবীর সকল স্বাদ বিনষ্ট করে চিরস্থায়ী নতুন এক জীবনের শুরু। যাকে আমরা পরকালের জীবন বলে থাকি। যে জীবনের শুরু থাকলেও শেষ বলতে কিছুই নেই। অথচ আমরা পদে পদে তুচ্ছ দুনিয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। তাইতো অনেক হতভাগা ভোগবাদী জীবনের পেছনে পড়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযগুলোও পড়ার সময় পায় না তারা। পিতা-মাতার খোঁজ-খবর নেওয়ারও সুযোগ হয় না তাদের। সকাল সন্ধ্যার আমল, যিকির-আযকার, কুরআন তিলাওয়াত, নফল সালাত ইত্যাদির জন্য খুঁজে পায় না সময়। নাভিশ্বাস জনজীবন। সদা ব্যস্ত তারা। এই ব্যস্ততা কতদিন? মৃত্যুর আগ পর্যন্তই তো! দম ফুরালে সব শেষ। কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কিন্তু তোমরা দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকো, অথচ আখিরাতের জীবন হলো উত্তম ও চিরস্থায়ী’। (সূরা আ‘লা- ১৬-১৭)।
কোথায় তারা আজ?
মহাবিশ্বে এমন কিছু নেই যা মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে। প্রতাপশালীর দাপট যেমন তার কাছে মূল্যহীন, তেমনি ক্ষমতাসীনের রক্তচক্ষুও তার সামনে অর্থহীন। আচ্ছা বলুন তো, সেসব প্রতাপশালী ক্ষমতাধররা কোথায়, যারা ক্ষমতার চেয়ার পেয়ে অসহায়দের উপর চালিয়েছিল নির্যাতনের স্টিমরোলার! যাদের ভয়ে সদা তটস্থ থাকতো জনপদের অসহায় মানুষগুলো! মৃত্যু তাদেরকে নিঃস্ব করে মাটির গর্তে নিক্ষেপ করেছে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাওয়ারফুল বাহিনী তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। বাঁচাতে পারেনি শক্তিশালী দেহরক্ষীরাও। কোথায় সেসব উঁচু উঁচু দালানের মালিকগুলো? কোথায় দুনিয়া লোভী ওই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত লোকগুলো? কোথায়? যারা দুনিয়ার বিত্ত-বৈভব ও সম্মানের আসন পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল। চিরস্থায়ী ভেবে ছিল এসব মরীচিকাকে। এসবের মাঝে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যখন তারা হেসে খেলে জীবন উপভোগ করেছিল নিশ্চিন্তে, হঠাৎ একদিন মৃত্যুদূত হানা দিল তাদের সুরম্য অট্টালিকায়। মুহূর্তেই ধরাশায়ী করে ফেলল তাদেরকে। নিয়ে গেল সংকীর্ণ অন্ধকার এক গর্তে। খালি হাতেই তাদেরকে চলে যেতে হয়েছে। তাদের রেখে যাওয়া ব্যাংক-ব্যালেন্স অন্যরা বণ্টন করে নিয়েছে। অঢেল ধন-সম্পদ, কাড়ি কাড়ি টাকা, প্রভাব-প্রতিপত্তি কোন কাজে আসেনি তাদের। আজ কোথায় সেসব আয়েশি লোকগুলো? যারা এসির বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে টিভি সিনেমায় বুঁদ হয়ে থাকত সারাক্ষণ! মদের বোতল হাতে নিয়ে নর্তকীদের ডান্স উপভোগ করত অহর্নিশ! কোথায় সেসব হ্যান্ডসাম যুবকগুলো? যারা সুন্দরী ললনার জন্য উৎসর্গ করেছিল নিজেদের যৌবন! বিলীন করে দিয়েছিল অর্থকড়ি! ভিন নারীর সাথে মধুর ফোন আলাপ ও চ্যাটিং-এ কাটাতো নির্ঘুম রাত! কোথায় সেসব রূপসী রমণীগুলো? যারা লাবণ্যময় চেহারা, মধুমাখা কণ্ঠস্বর এবং পর্দাহীন চলাফেরায় যুবকদেরকে আকৃষ্ট করত। ছলে বলে কৌশলে নিজেদের মায়াজালে বন্দী করত।
কোথায় সেসব সুঠামদেহী তরুণগুলো? যারা নিজেদের শক্তিমত্তাকে ব্যয় করেছে রবের অবাধ্যতায়! পলিটিক্যাল পাওয়ার পেয়ে দলীয় স্বার্থে জড়িয়ে পড়তো নানা ধ্বংসাত্মক হাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খলায়! হিংস্রতার বিষদাঁত ছড়িয়ে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত নিঃস্বদের ওপর! তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে ক্ষতবিক্ষত করতো নিরপরাধ মানুষের দেহ! রক্তে রঞ্জিত করতে অন্যের শরীর! প্রবৃত্তির তাড়নায় অবলা নারীদের সম্ভ্রমহানি করা ছিল যাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। সন্ত্রাস, লুটতরাজ ও টেন্ডারবাজিই ছিল যাদের দৈনন্দিন কাজ।
খালি হাতে সবাই গেছে চলি
কোথায় সেসব রক্তখেকো সুদখোর? যারা সুদের কাঁটা বিছিয়ে গরিবদের অভাবের পথকে আরো কণ্টকাকীর্ণ করেছিল! সুদসহ মূলধন দিতে না পারায় ভিটেবাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে পথে বসিয়েছিল তাদের! কোথায় সেসব নির্লজ্জ ঘুষখোররা? যারা সরকারের চাকরি পেয়ে আলিশান চেয়ারে বসে প্রাইম মিনিস্টারের ভাব নিত! উৎকোচ ছাড়া যেন বিকল হয়ে যেত তাদের সচল কলম! নিজের দায়িত্বটুকুও আদায় করত না তারা ঘুষ ছাড়া! তাদের রাক্ষুসে চাহিদা মেটাতে না পারলে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত লোকগুলোকে তাড়িয়ে দিত দূর দূর করে! মোটা অঙ্কের ঘুষের টাকা যোগান দিতে না পারায় উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষিতদেরকে বঞ্চিত করত উপযুক্ত পদ থেকে! কোথায় সেসব হারামখোররা? যারা রাতারাতি আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যেত! জনগণের মাল আত্মসাৎ করে গড়ে তুলত সম্পদের বিশাল পাহাড়! কোথায় তারা? নেই, কেউ নেই। এখন সবাই অন্ধকার কবরে। পচে গলে মাটির সাথে একাকার হয়ে গেছে তাদের দেহ। বিকৃত হয়ে গেছে তাদের সুন্দর মুখাবয়ব। মায়াবী চোখগুলোও খসে পড়েছে চেহারা থেকে। পোকামাকড়ের খাদ্যে পরিণত হয়েছে তাদের নাদুসনুদুস শরীর। এখন তাদের পদধ্বনি শোনা যায় না এ ধরায়। কুরআনের কথাই চিরসত্য, ‘আমি তাদের পূর্বে বহু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছি। আপনি কি ওদের কারো অস্তিত্ব টের পান, অথবা শুনতে কি পান ওদের কোন সাড়া-শব্দ?’ (সূরা মারিয়াম- ৯৮)।
এক খন্ড কাফনেই চির বিদায়
কোথায় আজ রাজকীয় বর্ণিল আয়োজনগুলো? কোথায় বিকৃত আনন্দে মেতে ওঠা নির্লজ্জ মজলিসগুলো?
মৃত্যু তাদের সকল আশা-আকাক্সক্ষা, স্বাদ-আহ্লাদ ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে। লন্ডভন্ড করে দিয়েছে তাদের বর্ণাঢ্য সব আয়োজন। কেড়ে নিয়েছে পার্থিব সকল অর্জন। এমনকি তাদের দেহ থেকে সামান্য কাপড়ের টুকরো টুকুও ছিনিয়ে নিয়েছে নির্মমভাবে। যে লোকটি দুনিয়ার মোহে উন্মাদ ও অসতর্ক ছিল, সম্পদ ও প্রাচুর্যের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বিকিয়ে দিয়েছিল নিজেকে, সে একখণ্ড কাফন ছাড়া আর কিছু নিতে পারেনি সাথে। কবরে তাদের ওপর চলছে অসহনীয় আজাব, ভয়াবহ যন্ত্রণা। আফসোস ও অনুশোচনায় ধুকে-ধুকে মরছে তারা। শত আফসোস এখন কোন কাজে আসছে না তাদের। কুরআনের ভাষ্যই যথাযথ- ‘বড় দুর্ভোগ প্রত্যেক ওই ব্যক্তির, যে নিন্দা করে, দোষ খোঁজে বেড়ায়। যে সম্পদ সঞ্চয় করে ও বারবার তা গণনা করে। সে ধারণা করে, তার ধনসম্পদ তাকে চিরজীবী করে রাখবে। কখনোই না নিশ্চয়ই ওকে নিক্ষেপ করা হবে সেই পিষ্টকারী (আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন)-এর মধ্যে।’ (সূরা হুমাযাহ- ১-৪)।
ভাবনায় আমিহীন দুনিয়া
নিরবে নিভৃতে একটু ভাবুন তো, আজ থেকে ১০০ বছর পূর্বে ক্যালেন্ডারের পাতায় যখন ১৯২৩ সাল ছিল। তখনকার পৃথিবীতে বিচরণকারী প্রায় সব মানুষ এখন পরপারে, কবর জগতে। একইভাবে আজ থেকে ১০০ বছর পর ক্যালেন্ডারের পাতায় যখন ২১২৩ সাল। বর্তমানে জীবিত আমরা সবাই তখন মাটির নিচে, একলা ঘরে, চিরচেনা সেই গোরস্থানে।
হ্যাঁ, এটাই বাস্তবতা। নিজেকে মাটির নিচে কল্পনা করে ভাবনার সাগরে একটু ডুব দিন তো। ঘামঝরা পরিশ্রমের টাকায় নির্মিত আপনার সুন্দর বাড়িতে বসবাস করছে পরবর্তী জেনারেশন। আপনার দামি স্মার্টফোনটিও ব্যবহার করছে অন্য কেউ। আর শখের ঘড়িটি! তাও হয়তো শোভা পাচ্ছে অন্য কারো হাতে। আপনার পছন্দের জামা জুতো ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। আপনার দামি ব্রান্ডের বাইকটিও চালাচ্ছে অন্য কেউ। আপনার প্রস্থানে প্রকৃতির কোথাও ছন্দপতন হবে না। দিনের কোলাহল, রাতের নিস্তব্ধতা, ভোরের শিশির, শীতের কুয়াশা, পাখিদের কলরব, কোকিলের কুহু কুহু ডাক। সবকিছু চলবে ঠিকঠাক। আগের মতই মেঘমালা ছুটে চলবে, আকাশ থেকে বৃষ্টি হবে, ভূমি থেকে ফসল হবে, প্রখরতা ছড়াবে তেজস্বী সূর্য, মিষ্টি আলো বিলাবে জোৎস্নামাখা চাঁদ। আপনার বিরহে এসবের নিয়মে কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। শুধু থাকবেন না আপনি! হ্যাঁ, আপনিই! কিছুদিন হয়তো আপনার আলোচনা হবে মানুষের মুখে। স্বজনরা আপনার স্মরণে অশ্রুসিক্ত হবে। ধীরে ধীরে সবাই ভুলে যাবে আপনাকে।
যাদের আরাম-আয়েশের জন্য নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করেছেন আপনি, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন ক্লান্ত দেহে, হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে টাকা কামাই করেছেন দু হাতে, তারাই আপনাকে অন্ধকার কবরে ফেলে ফিরে এসেছে পরিবার-পরিজনের কাছে। আপনার কষ্টার্জিত সম্পদ ভোগ করছে পরমানন্দে। আপনাকে নিয়ে ভাবার তাদের সময়ই বা কই! সবাই ব্যস্ত থাকবে আপন কাজে। মগ্ন থাকবে নিজ চিন্তায়। এটাই দুনিয়া। এটাই এখানকার নিয়ম। কিন্তু বেদনার কথা হলো, যে অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের প্রত্যেককেই, সেই মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা চরম উদাসীন। আর যে দুনিয়া আমাদেরকে চরম নিষ্ঠুরতার সাথে এ জগত থেকে বিতাড়িত করবে, সে দুনিয়াকে আপন করতেই আমরা মরিয়া। এ জীবন সাজানোর জন্যই আমাদের রাত-দিনের ব্যস্ততা। একে ঘিরেই আমাদের যত ধ্যানজ্ঞান, বিরামহীন সাধনা। কতদিন চলবে প্রাচুর্যের এ প্রতিযোগিতা? সর্বোচ্চ কবর পর্যন্তই তো। লক্ষ করুন আল্লাহর বাণী- ‘প্রাচুর্যের লোভ তোমাদের গাফেল করে রাখে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌঁছে যাও। কখনোই না! শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। পুনরায় (বলছি) কখনোই না! শীঘ্রই জানতে পারবে।’ (সূরা তাকাছুর, ১-৮)।
দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে উসমানীতে উল্লেখ আছে, অর্থাৎ ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য এবং দুনিয়ার উপায় উপকরণের লোভ মানুষকে গাফলতের জালে ফাঁসিয়ে রাখে, মহান মালিকের ধ্যান ও আখেরাতের ফিকির কোনটিই আসতে দেয় না। রাতদিন একই চিন্তা- যেভাবেই হোক ধন দৌলতের আধিক্য হতে হবে এবং আমার বংশ ও দল সকল বংশ ও দলের ওপর প্রবল থাকতে হবে। উদাসীনতার এই মোহ কাটে না যতদিন না মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়। তখন কবরে পৌঁছে বুঝতে পারে যে, সে মারাত্মক গাফিলতিতে ও ভুলের মাঝে ছিল। মাত্র কয়েক দিনের আনন্দ-উৎসব ছিল। মৃত্যুর পর সেসব সাজ-সরঞ্জাম অসার বরং প্রকৃত জীবনের জন্য বিপদ প্রমাণিত হলো। (তাফসীরে উসমানী- ৪/৭৩৭)।
যিনি বলেছেন যথার্থ বলেছেন, ‘মানুষ খালি হাতে আসে। তারপর দুনিয়ার সবকিছু পেতে চায়। তারপর সবকিছু ছেড়ে খালি হাতে চলে যায়। তারপর সব কিছুর জন্য হিসাবের মুখোমুখি হয়।
হঠাৎ আসবে ওপারের ডাক
সাধারণত মৃত্যুর ব্যাপারে আমাদের ফিলিংস হচ্ছে, আরে, সে তো বৃদ্ধ বয়সের ব্যাপার। বয়স যখন ৭০/৮০ পার হবে, বার্ধক্যের ভারে শরীর নুয়ে পড়বে, তখন ক’দিন রোগে ভোগবো আর শয্যাশায়ী হয়ে কবরে পাড়ি জমাব। কিন্তু একঘণ্টা পরেও যে মারা যেতে পারি কিংবা পরিকল্পিত কাজ সমাপ্ত করার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারি- সে অনুভূতি কজনই লালন করি! এটাই কি বাস্তবতা নয়? আমাদের আশেপাশেই তো এমন ঘটছে ভূরি ভূরি! মৃত্যু চলে আসবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই। এই অমোঘ বিধানটি বিস্মৃতির ফলে আমাদের জীবন-চাকা চলতে থাকে গতানুগতিক ধারায়। ঘুরপাক খেতে থাকে এক অর্থহীন চক্রে। ভাবি, যাক না আরও কিছুদিন এভাবে। শেষ বিদায়ের আগে তাওবা করে পাক্কা দ্বীনদার হয়ে যাব। আর সোজা চলে যাব জান্নাতের ফুলেল উদ্যানে। অথচ আজকের দিনটিই বেঁচে থাকার কি আছে কোন গ্যারাণ্টি? তাওবার সুযোগ লাভেরই বা আছে কি কোন নিশ্চয়তা? বলুন! তাইতো পেয়ারা নবী (সা.) আমাদেরকে সতর্ক করে বলেন, ‘তোমরা কার্যসম্পাদনে সাতটি বিষয়ের অগ্রগামী হও। তোমরা কি এমন দারিদ্র্যের অপেক্ষায় আছো, যা আল্লাহ তাআলাকে ভুলিয়ে দেয় অথবা এরূপ ধনবান হওয়ার, যা আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতায় লিপ্ত করে অথবা এমন রোগের, যা স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দেয় অথবা নির্বোধে পরিণতকারী বার্ধক্যের অথবা এমন মৃত্যুর, যা হঠাৎ করেই এসে যায় অথবা অপেক্ষা করছো দাজ্জালের অপেক্ষমাণ অদৃশ্য অমঙ্গলের অথবা কিয়ামতের? আর কিয়ামত তো আরো বিভিষিকাময়, আরো তিক্ত’। (সুনানে তিরমিযী- ২৩০৬)।
নিঃশ্বাসের নেই বিশ্বাস
দুনিয়া একটা পরীক্ষা কেন্দ্র। শেষ ঘন্টা বেজে গেলে আমলনামার খাতা কেড়ে নেওয়া হবে। জাগতিক পরীক্ষার হলে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর কখনো দু’এক মিনিট লেখার সুযোগ থাকে। কিন্তু জীবনের সময় শেষ হয়ে গেলে এক মুহূর্তও বিলম্ব করা হবে না। তাই যা লেখার দ্রুত লিখে ফেলতে হবে। পূণ্যের সমাহারে জীবনকে সাজাতে হবে। কেননা, মৃত্যুর দিন সম্পর্কে কেউ জানে না। এমনকি যখন এই দিন চলে আসবে সেইদিনও সে জানবে না, আজ তার মৃত্যুর দিন। তাছাড়া কার মৃত্যু কোথায় হবে সেটাও সবার অজানা। যার মৃত্যু যেখানে স্বেচ্ছায় চলে যায় সেখানে। তাইতো মৃত্যু যদি সমুদ্রের গভীরে লেখা থাকে, কোটি টাকা ব্যয় করে সাবমেরিন ভাড়া করে হলেও মানুষ সেখানে উপস্থিত থাকে। এমনটাই তো ঘটেছে কিছুদিন আগে। ভাবার বিষয় হলো, আমি কি প্রস্তুতি নিতে পেরেছি কবরে যাওয়ার? পেরেছি কি ওপারের পাথেয় সংগ্রহ করতে যথাযথ। মৃত্যুর সময় যে ঘনিয়ে এলো! কী দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে বেলা!
লাইফ তো একটাই। মিস হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার পাওয়ার চান্স নেই। আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করে চলো। এবং প্রত্যেক ব্যক্তির ভেবে দেখা উচিত সে আগামী কালের জন্য কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলো তোমরা যা কিছু করো, নিশ্চয়ই সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।’ (সূরা হাশর- ১৮)।
মৃত্যুর নোটিশ
ভাই আমার! মৃত্যু আমাদেরকে বহুবার সতর্ক করেছে। কখনো আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর মাধ্যমে। কখনো বন্ধুবান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীর মৃত্যুর মাধ্যমে। আবার কখনো বৈশ্বিক মহামারী ও দুর্যোগে লক্ষ লক্ষ মানুষের চির বিদায়ের মাধ্যমে। মৃত্যুদূত আমাদেরকে নোটিশ পাঠিয়েছে বারবার। কচকচে কালো দাঁড়ি শুভ্র-সফেদ হওয়া, বয়সের বাড়ে শরীর নুয়ে পড়া, নানা রোগ- ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া- এসব কি তার নোটিশ নয়? বলুন! তাছাড়া জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পর নাতি-নাতনিদের দাদা ও নানা বলে আদু আদু ডাকও মৃত্যুর আগমনী বার্তা। তাই আমাদের উচিত সেসব জিনিস নিয়ে ভাবা যা মানুষকে আখেরাতমুখী করে তোলে। আর তা হলো, মৃত্যুর স্থানের দিকে তাকানো, মৃত্যুকে সদা স্মরণ করা, কবর যিয়ারত করা, জানাযায় উপস্থিত হওয়া, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বেদনায় কাতর ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া, মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা এবং মৃত ব্যক্তিদের কথা মনে করা। নিরবে নিভৃতে তন্ময় হয়ে এসব ভাবলে দুনিয়াপ্রীতি দূর হয়ে যায় আপনাতেই। পার্থিব জীবনের ভোগ-বিলাসের প্রতিও মনে সৃষ্টি হয় অনাগ্রহ। তাছাড়া মৃত্যু বিষয়ক হৃদয়স্পর্শী উপদেশমালা আর্ট বা ক্যালিগ্রাফি করে বেডরুমে টাঙিয়ে রাখতে পারেন। যাতে তা ক্ষণে ক্ষণে চোখে পড়ে এবং মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘মানুষ যদি দুনিয়ার সম্পদ পেয়ে ধনী হয়ে থাকে, তুমি আল্লাহকে পেয়ে ধনী হও। তারা যদি দুনিয়াকে নিয়ে আনন্দিত হয়, তুমি আল্লাহকে নিয়ে আনন্দিত হও। তারা যদি বন্ধুদের সাথে স্বস্তি অনুভব করে, তুমি আল্লাহর সাথে স্বস্তি অনুভব করো। তারা যদি সম্মান ও মর্যাদা লাভের জন্য রাজা-বাদশাহদের সাথে পরিচিত হয়, তাদের নৈকট্য অর্জন করে, তবে তুমি আল্লাহর সাথে পরিচিত হও, তার ভালোবাসা অর্জন করো, তুমিই হবে প্রকৃত মর্যাদাবান’। (আল-ফাওয়ায়িদ, পৃষ্ঠা- ১৫২)।
শেষ বিদায়ের সঙ্গী
সত্যি বলতে কী, দু’দিনের এই পান্থশালাকে ঘিরেই তৈরি হয়ে চলছে মানুষের অন্ধ জীবনের ব্যস্ত-ধারাপাত। চাকচিক্যময় এই দুনিয়া তার সর্বোচ্চ সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়ে মানুষকে ডাকে। মেকি রূপ-রস-গন্ধের ছলনায় তার মায়াজালে আটকানোর চেষ্টা করে আমাদের। মনে রাখতে হবে, দুনিয়ার প্রাচুর্য ও চাকচিক্য সাময়িক। প্রাণ পাখি উড়াল দেওয়ার সাথে সাথেই সব হাতছাড়া হয়ে যাবে। চলে যাবে অন্যের মালিকানায় কাড়ি কাড়ি সঞ্চিত সব সম্পদ। সঙ্গী হবে শুধু ইখলাস পূর্ণ আমল। আনাস ইবনু মালিক (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে মহানবী (সা.)বলেছেন-
يَتْبَعُ الْمَيِّتَ ثَلاَثَةٌ فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى مَعَهُ وَاحِدٌ يَتْبَعُهُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ فَيَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ وَيَبْقَى عَمَلُهُ‘
তিনটি বস্তু মৃত ব্যক্তির অনুসরণ করে। দু’টি ফিরে আসে, আর একটি তার সঙ্গে থেকে যায়। তার পরিবারবর্গ, তার মাল ও তার আমল তার অনুসরণ করে। তার পরিবারবর্গ ও তার মাল ফিরে আসে এবং তার আমল তার সঙ্গে থেকে যায়। (সহীহ বুখারী- ৬৫১৪)।
সুতরাং কবর থেকে শুরু করে আখেরাতের সফরের সকল মঞ্জিলে যে জিনিস আমাদের সাথে থাকবে তাকে সুন্দর থেকে সুন্দরতর করাই আমাদের দ্বীন ও দুনিয়ার সকল কাজের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। মৃত্যু এসে গেলে ধনী-গরিব সবাইকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সাড়ে তিন হাত কবরের ভেতর। মাটির নিচে রাজা-প্রজার হিসাব নেই। মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান নেই। সেখানে সবাই সমান। তাই মানুষকে সম্মান দিন। সবার সাথে সদাচারণ করুন। আপনার বিনয়-নম্রতা ও সুন্দর ব্যবহার মানুষের হৃদয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। নির্জনে বসে নিজেকে সম্বোধন করে বলুন- ‘হে পরকালের অভিযাত্রী, তুমি তোমার আমলকে সুন্দর করো। সমৃদ্ধ করো পরকালের সঞ্চয়। কেননা, তোমার সময় ঘনিয়ে এসেছে’।
হৃদয়কাননে ফুটুক কোমলতার ফুল
প্রিয় ভাই আমার, আপনার যখন মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হবে, সে সময়টি একটু স্মরণ করুন! কল্পনা করুন সেই দৃশ্যটি, যখন আপনাকে কবরে নামানো হবে! মনে করুন সেই সময়টি, যখন আপনাকে বাঁশতলায় নির্জন কবরে রেখে আসবে। আর ফিরে যাবে সবাই আপন ঠিকানায়। তাই বেলা ফুরাবার আগেই ঠিক ঠিক চিনে নিতে হবে আমাদের আসল গন্তব্য। সন্ধ্যার ঘন ঘন আঁধার নেমে আসার আগেই জীবন তরীটিকে ভেড়াতে হবে নেক আমলের তীরে। মোহ আর মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে আমাদেরকে ছুটতে হবে আদিগন্ত অনন্তের পথে। ভ্রান্তির মায়াজাল ভেদ করে চলে আসতে হবে একলা ঘরে। হায়, এখনো কি সময় হয়নি রবের দিকে ফিরে আসার? এখনো কি সময় হয়নি প্রস্তর-কঠিন হৃদয়ে কোমলতার ফুল ফোটাবার? হায়, পাপ-পঙ্কিলতা ছেড়ে কখন ফিরে আসব শুভ সুন্দর নির্মল পথে? দুর্বার গতিতে কখন ছুটে চলবো অনিন্দ্য সুন্দর জান্নাতের দিকে? রব্বে কারীম কত মায়াবী ভাষায় আমাদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন- ঈমানদারদের জন্য কি এর সময় আসেনি যে, তাদের অন্তর বিগলিত হবে আল্লাহর স্মরণ ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার সামনে? এবং তারা ওদের মতো হবে না, যাদের ইতঃপূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর ওদের ওপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হলো? ফলে ওদের অন্তর কঠিন হয়ে গেল আর ওদের অনেকেই (চরম) নাফরমান’। (সূরা হাদিদ- ১৬)।
লেখক: উস্তাযুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়েতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/