আজ পর্যন্ত অন্য ধর্মের উপাস্য, দেব-দেবী, অবতারকে নিয়ে মুসলমানরা কোনো কটূকাটব্য করেনি। কারো দূর্নাম করে বই লিখে প্রকাশ করেনি, কার্টুন চিত্র আঁকে না, পর ধর্মের বিধি-বিধানের নিন্দাবাদ করে না। অথচ মহানবী (সা.)কে নিয়ে বিধর্মীরা তো বটেই, কিছু প্রগতিশীল মুসলমানও বিশেষতঃ বাংলাদেশে কবিতা লেখে, কার্টুন আঁকে। এটা মুসলমানের পক্ষে ক্ষমাহীন অপরাধ। তবু পার পেয়ে যাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অজুহাতে। এই অজুহাতে মুসলমানরা কি এরূপ কিছু করতে পারে? না, পারে না। কারণ দ্বীনদার মুসলমানের পক্ষে তা নিষিদ্ধ।
অধূনা মুসলমানে মুসলামানে মত পার্থক্য বিশ্বব্যাপি। অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না। কারণ, সকলেই এক আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট বান্দা। বান্দা এ কারণে যে, আল্লাহর কিতাব আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, “আনা খালাক্বতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিয়া’বুদূন”। অর্থাৎ- আমি জ্বিন ও ইনসানকে আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাহলে ইনসানের জন্যে ইবাদত পালন অবশ্য পালনীয়। যারা ইবাদত করবে, তারা আবেদ অর্থাৎ- আল্লাহর বান্দা। আল্লাহ কুরআন পাকে ইরশাদ করেন, “যে ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করে, তার থেকে সেটা কবুল করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (সূরা আলে-ইমরান, ৮৫)।
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, “তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করিও না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”। (সূরা বাক্বারা- ২০৮)।
প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের জন্যে আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র ধর্ম ইসলাম। তাই মুসলমানকে আল্লাহ মনোনীত ধর্ম মেনে নিতে হবে। মানুষের জন্য ধর্ম। তাই ধর্মনিরপেক্ষ হবার সুযোগ কারো নেই। অথচ আমাদের শুধু নয়, আরো কিছু কিছু মুসলিম রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে নিয়েছে। অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম দেশের খবর জানি না। তবে জানি, আমাদের বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান নামধারীরা ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ অনুবাদ করে ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’ বানিয়ে নিয়েছে। এরা যেন আল্লাহ নামটি সহ্য করতে পারছে না। অথচ এদেশের ৭% হিন্দু সংখ্যালঘুরা ভগবান বা ঈশ্বর বাদ দেয়নি। এটা তারা ঠিকই রেখেছে ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যেও। আর, নাদান মুসলমান আল্লাহকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। আল্লাহর নাম না নিলে তারা মুসলমান বলে দাবী করে কী করে? আর তার প্রয়োজনই বা কিসের?
গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর এর নয়াদিগন্ত পত্রিকায় রাযী উদ্দীন কুরেশী ‘কুরবানী ব্যবস্থাপনাঃ একটি পরামর্শ’ নামে একটি ছোট নিবন্ধে লিখেছেন-
(১) কুরবানী বাড়িতে বাড়িতে হবে না, হবে প্রতি পাড়ায় বা এলাকার নিকটস্থ মাঠে। গোশত বিতরণও বাড়িতে বাড়িতে হবে না, হবে কুরবানির মাঠে।
(২) মেয়রেরা বা মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যানেরা ঘোষণা করে দেবেন, অমুক এলাকাবাসীর কুরবানী অমুক মাঠে হবে। কেউ বাড়িতে কুরবানি করবে না। নির্ধারিত মাঠে আগে থেকেই বড় গর্ত করে রাখা এবং এর চতুর্পার্শ্বে পশু জবাই হবে। রক্ত ও বর্জ গর্তে নিক্ষিপ্ত হবে। জবাই ও গোশত কাটা শেষ হওয়ার পর গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করে দুরমুছ করে দাবিয়ে সমান করে দেয়া হবে। প্রয়োজনে রোড রোলারও চালানো যেতে পারে। যাতে মাঠ ব্যবহার উপযোগী হয়ে যায়। রক্তাক্ত স্থানগুলোতে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দেয়া হবে।
(৩) কুরবানী দাতারা গরিবদের প্রাপ্য অংশের গোশত মাঠেই স্তুপাকার করে রেখে নিজ নিজ গোশত নিয়ে যাবেন। (বিশেষ কোনো গরিবকে একান্তে দেয়ার জন্য গরীবের অংশ থেকে কিছু গোশত নিয়ে যেতে পারেন)।
(৪) পশুর চামড়া কুরবানির মাঠেই বিক্রয় বা বিতরণের ব্যবস্থা থাকবে। কোনো কুরবানিদাতা নিজ পশুর চামড়া নিয়ে যেতে চাইলে নেবেন।
(৫) কুরবানিদাতার রেখে যাওয়া গরিবের অংশের গোশত একত্র করে সব শেষে মাঠে সমবেত গরিবদের মধ্যে লাইন করে বিতরণ করা হবে।
(৬) প্রত্যেক কুরবানিদাতা নিজ নিজ কসাইয়ের প্রাপ্য পরিশোধ করবেন এবং পশুর ধরণ (গরু, ছাগল ইত্যাদি) ভেদে সামান্য অংকের একটা পূর্ব নির্ধারিত চাঁদা (মাঠ কমিটিকে) পরিশোধ করবেন। যা দিয়ে বিভিন্ন সেবামূলক কাজের জন্য সেবাদান কারীদের প্রাপ্য পরিশোধ করা হবে।
(৭) এসব ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি বছর মাঠ বা এলাকা প্রতি একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি সিটি কর্পোরেশন বা মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ গড়ে দেবেন।
(৮) এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করতে কর্তৃপক্ষ প্রথম দিকে খবরের কাগজ ও টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থা করবেন।
রাযী সাহেবের পরামর্শে গর-রাযী হবার কোনো কারণ নেই, যদি তা সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিপালিত হয়। তবে ‘অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ হবার আশংকা থাকে বলে আমাদের দেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। শহরের খবর আমার জানা নেই। তবে গ্রামে সেই ব্রিটিশ রাজত্বের প্রান্তকাল থেকে এ পর্যন্ত দেখে এসেছি যে, কুরবানির কারণে কখনো পরিবেশ দুষিত হয়নি এবং শহরেও কুরবানীর দূষণের জন্যে কোন প্রতিবাদ বা মিছিল, মিটিং এর কথা শুনিনি।
তবে রাযী সাহেব তার পরামর্শমূলক নিবন্ধের শুরুর দিকে লিখেছেন, “শুধু বাহ্যিক পরিবেশ সমস্যা নয়, আরো আছে। আমাদের অনেক নাগরিকের কাছে গরু পূজনীয়। সংখ্যলঘু হওয়ার কারণে অন্তরে তালা দিয়ে তাদের রাস্তায় এ সব বর্জ্য অতিক্রম করতে হয়। ছয় সাত দশক আগে একটা গ্রামোফোন রেকর্ডের গান ছিল, ‘কারো মনে তুমি দিওনা আঘাত, সে আঘাত লাগে কা’বার ঘরে’। আমাদের কথিত নাগরিকদের মনের আঘাত কারো কুরবানিকে আঘাত করছেনা তো? আর বিদেশীরা অবস্থা দেখে কিভাবে, তারাই জানে। তবে তা না শোনাই ভালো”।
রাযী সাহেব আবার নামের সাথে কুরেশী পদবী লাগিয়েছেন। তিনি কি আবু লাহাবের বংশধর? আর পরামর্শের আসল কারণটা জানা যায় তার প্রাথমিক বক্তব্য থেকে। দেশের ৭/৮ পার্সেন্ট গো পূজারীর মানসিকতা বিবেচনায় এনে তিনি তার পরমর্শগুলো দিয়েছেন। তিনি কি জানেন না, ভারতের বহু রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে? সেস্থানে বসবাসকারী মুসলমানদের আবশ্যকীয় ইবাদত গো কুরবানির উপায় কি? কুরবানী মুসলমানদের উপর ওয়াজিব। এটা বিত্তবান মুসলমানদের কাছে অলঙ্ঘনীয়। তা’ যদি তারা না করতে পারেন, তাতে কি সেখানকার মুসলমানদের মনে আঘাত লাগবে না? অবশ্যই লাগবে। তবে হিন্দুদের জগন্নাথ মন্দির-রামমন্দিরে আঘাত লাগবে না নিশ্চয়ই। কেননা, সে রকমের গান গ্রামোফোন রেকর্ডে শোনা যায়নি। তবে খবর কাগজে জানা গেছে, অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে রাম মন্দির বানাবার কথা। সেটা হিন্দু ভারতের ব্যাপার। তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর অবশ্যক কী? রাযী কুরেশী সাহেব শুনে থাকবেন হয়তো, ভারতীয় চ্যানেলে (টিভি) এই গান ‘এই ফালগুণে পূর্ণিমা রাতে চল পলায়ে যাই’। সংখ্যালঘুদের (যারা গো পূজারী) মনে আঘাত না লাগানোর জন্য মুসলমানদের যিলহজ্ব মাসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে সবচাইতে ভালো হয় না? বাংলাদেশে মুসলমানের দশা যাই হোক, সংখ্যালঘুরা যেন সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারেন। কারণ, এ দেশটা তো তাদের অনেকের মামা বাড়ী, শ্বশুর বাড়ী।
কুরেশী সাহেব নিশ্চয় জানেন, এই ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম সংখ্যাগুরুর (৯০%) বাংলাদেশে ৭% সংখ্যালঘু হিন্দুদের পূজা-পার্বনে, ঢাক-ঢোল কাঁসা বাজানোর কানফাটা আওয়াজে কোনো দ্বীনদার মুসলমানও অতীষ্ঠ হয়ে কোনো ফাতওয়া জারি করেনি। কেননা, আল্লাহ তাঁর কিতাব আল-কুরআনে কাফিরদের সম্পর্কে মহানবী (সা.)কে বলতে ইরশাদ করেছেন, ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালি-ইয়াদ্বীন’। অর্থাৎ- তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার। তদর্থে তারা নবী (সা.) প্রচারিত ইসলামে না এসে, তাদের ধর্ম তারা পালন করলে মুসলমানের অন্তরে আঘাত লাগার কোনো কারণ নেই। মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ ইরশাদ করেন, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, মিথ্যা মূর্তিপূজা হতে দূরে থাক”। (সূরা নহল- ৩৬)।
কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বাংলাদেশে কী হচ্ছে? যারা ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান, তারা হিন্দুদের জন্মাষ্টমী (ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন) এবং দূর্গ পূজার মিটিংয়ে, মিছিলে, প্রতিমা বিসর্জনে অংশ নিচ্ছে। তাদের অবশ্যই আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ইহুদী খ্রীস্টানদের দেশেই শুধু নয়, মুসলিম দেশেও ধর্মনিরপেক্ষতা বহাল হচ্ছে। আজ পর্যন্ত অন্য ধর্মের উপাস্য, দেব-দেবী, অবতারকে নিয়ে মুসলমানরা কোনো কটূকাটব্য করেনি। কারো দূর্নাম করে বই লিখে প্রকাশ করেনি, কার্টুন চিত্র আঁকে না, পর ধর্মের বিধি-বিধানের নিন্দাবাদ করে না। অথচ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে বিধর্মীরা তো বটেই, কিছু প্রগতিশীল মুসলমানও বিশেষতঃ বাংলাদেশে কবিতা লেখে, কার্টুন আঁকে। এটা মুসলমানের পক্ষে ক্ষমাহীন অপরাধ। তবু পার পেয়ে যাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অজুহাতে। এই অজুহাতে মুসলমানরা কি এরূপ কিছু করতে পারে? না, পারে না। কারণ দ্বীনদার মুসলমানের পক্ষে তা নিষিদ্ধ।
পরের দোষকীর্তনকে ইসলামে বলা হয় গীবত। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আল-গিবাতু আশাদ্দু মিনায্ যিনা’ গীবাত যিনার চেয়েও বড়। অর্থাৎ- যিনার পাপের চাইতেও অধিক পাপ গীবাত (পর চর্চায়)। যে ধর্ম মানি না, সে ধর্ম বা সেই ধর্মের অবতারাদি সম্পর্কে ‘না করি নিন্দা, না বলি সাবাস, রসনা মৌন রবে’। তাই দ্বীনদার মুসলমান, তারা ওসবে নেই, যারা নামের মুসলমান তারা হিন্দুদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। দ্বীনদার মুসলমান শিক্ষাগ্রহণ করেন, আল-কুরআন এবং মহানবী (সা.) এর জীবন এবং বানী (হাদীস) থেকে।
বাংলাদেশে মুসলমানদের গোদের উপর বিষফোঁড়া হলো সংখ্যালঘু নির্যাতন। আর, এটা বর্তায় গিয়ে মৌলবাদী মুসলমানদের উপর। তারা ব্যতীত কারা আর সংখ্যালঘু নির্যাতন করবে? এটা অবধারিত। তথাপি ২১ সেপ্টেম্বর এর নয়াদিগন্ত থেকে একটি সংবাদ তুলে ধরছি। ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা শান্তিতে নেই’ রানাদাসগুপ্ত। (এনা নিউ ইয়র্ক)। বক্তব্য রেখেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানাদাসগুপ্ত। সম্মেলনটি ১৯ সেপ্টম্বর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হয়। রানাদাস গুপ্ত বলেন, “স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা সুখে নেই। শান্তিতে নেই, স্বস্তিতে নেই। পাকিস্তান আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করে তাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে”।
তিনি আরো বলেন, “৭১ সালের পরাজিত শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। তারা ক্ষমতায় থেকে এবং ক্ষমতার বাইরে থেকে টানা হামলা চালাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ওপর। বর্তমান সরকারে থাকা একটি পরগাছা গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করছে। আমার চোখ তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আছে, কিন্তু তারা প্রতিকারের পথ হারিয়ে ফেলেছে…..। বিএনপি মনে করে সংখ্যালঘু কমলে দেশ বাঁচবে, ধর্ম বাঁচবে। আওয়ামীলীগের অবস্থা হয়েছে, থাকলে ভোট আমার, আর চলে গেলে ভূমি আমার”।
এ্যাডভোকেট রানাদাস গুপ্তের বক্তব্যের সংগে দেশের পুরো হাল-চাল মিলছে বলে আমার আদৌ মনে হচ্ছে না। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা দেশের সরকার এবং সংখ্যাগরীষ্ঠদের মন মানসিকতা সম্পর্কে এরূপ বিরূপ মন্তব্য করা যায় না। ঢাকার রাস্তায় দর্জী যুবক বিশ্বজিৎকে পিটিয়ে মারা হয়েছে ছাত্র শিবির সন্দেহে, হিন্দু হিসেবে নয়। এ রকমের দু’একটি ঘটনা এভাবে ঘটে যেতে পারে। এসবই দুর্ঘটনা, তবে মর্মান্তিক। ২০০২ সালে গুজরাটে যা ঘটে গেছে, তা নিশ্চয় দাশগুপ্ত বাবুর অজানা নয়। সেটাও ঘটেছিল সন্দেহের কারণে। তবে মুসলমান মারা গিয়েছিল অন্ততঃ হাজার খানেক। আর, পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে হয়েছিল তারচেয়েও অধিক সংখ্যক মুসলমানকে। নিশ্চয় জানেন, কাশ্মীরের ৮০% মুসলমান এখন ৬০% এ। বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির বানানোর চেষ্টা অযোধ্যায়। আবার কিছুকাল পূর্বে ভারতীয় আরএসএস ঘর ওয়াপেসী (ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া) প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে দরিদ্র অশিক্ষিত মুসলমানদের আবার হিন্দুত্বে ফিরিয়ে নেবার জন্য, তাদের পূর্ব পুরুষ নাকি হিন্দু ছিল। এসব খবর দাশগুপ্ত বাবুর অজানা থাকবার কথা নয়। আর, সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশীদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে চলেছে। ফেলানী নামের কিশোরীকে হত্যা করে কাটাতারে ঝুলিয়ে রাখার খবরও আপনার অজানা নয়। তারাপরও তো আপনারা এখানে সহসমাদরে আছেন, বড় বড় সরকারি চাকুরীতে বহাল আছেন। আপনাদের পুজা পার্বনে কতিপয় বিশিষ্ট মুসলমানদের অংশ গ্রহণ পাচ্ছেন। আর কী কী চাই আপনাদের এদেশে?
যা বলতে চেয়েছিলাম, তা থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছি। এটা স্বাভাবিক। ৮০ বছর বয়স হয়ে গেলে সব সময় বিষয়ানুগ কথা বলতে গেলে, তার মধ্যে দু’ একটা ফালতু কথা এসে পড়তে পারে। হয়েছেও তাই। এবার ফিরে আসি আল্লাহর কথায়। কুরআন পাকে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী খ্রীস্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পরের বন্ধু এবং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে, সে তাদেরই একজন হয়ে যায়। নিশ্চয় আল্লাহ অত্যাচারীকে হিদায়াত করেন না”। (সূরা মায়েদা- ৫১)।
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন, “ইহুদী এবং মুশরিকদেরকে তুমি ঈমানদারদের প্রধান দুশমনরূপে দেখতে পাবে”। (সূরা মায়েদা- ৮২)।
আল্লাহর আরো একটি ইরশাদ, “আমি অবশ্যই শয়তানদেরকে বেঈমানদের বন্ধু করেছি”। (সূরা আরাফ- ২৭)।
চৌদ্দশত বছর পূর্বে মহানবী (সা.)এর উপর শেষ এবং শ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব আল-কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আজ চৌদ্দশত বছর পরেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কিতাবের সকল কথাই সম্পূর্ণ যথার্থ। কিতাবেই আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যা-লিকাল কিতাবু লা রাইবা ফীহ’ এই কিতাবে কোনো সন্দেহ নেই। ইহুদী নাসারা মুশরিকরা বরাবার মুসলমানদের সঙ্গে দুশমনি করে এসেছে। আজও দুশমনি করছে। তবে একটু তফাৎ এই যে, এখন বন্ধু সেজে দুশমনী করছে। বন্ধু সেজে দুশমনী করা সহজসাধ্য।
আর, আহম্মক মুসলমানরা তাদের ফাঁদে পা রাখছে পরম নির্ভাবনায়। যারা ওদের ফাঁদে পা রেখেছে, বন্ধু করে নিয়েছে, তারা আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (সা.)এর বানীকে উপেক্ষা করছে। আর, তার ফলও পাচ্ছে হাতে নাতে। কিন্তু তাদের বোধোদয় হচ্ছে না। ইসলামকে ওরা বলছে মৌলবাদ জংগীবাদ। আর, ওদের ফাঁদে পা রাখা নাদান মুসলমানও দ্বীনদার মুমিন মুসলমানকে বলছে মৌলবাদী জংগী। মুসলমানদের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তি সৃষ্টি করে ঈমানহারা করা শয়তানের কাজ। ইহুদী, নাসারা, মুশরিকরা সেই শয়তানের কাজই আনজাম দিচ্ছে। তাই মুসলমান হিন্দুদের পুজায় অংশ নিচ্ছে। আর, হিন্দুদের মুসলমানের গো কুরবানী অসহ্য।
খেলাফত ভেঙ্গে যাবার পরও স্পেনে মুসলিম রাজত্ব কায়েম ছিল। ২০০ বছর খ্রীস্টানেরা ক্রুসেড চালিয়ে সাড়ে সাত শত বছরের মুসলমানদেরকে স্পেন থেকে মেরে তাড়িয়ে দখল করে নেয়। মিশরের নির্লিপ্ততার সুযোগে ফিলিস্তিনীর অংশ বিশেষ দখল করে অবৈধ ইসরাঈল রাষ্ট্র কায়েম করে নিয়েছে, যাযাবর ইহুদীরা। ফিলিস্তিন ব্যতীত অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র সে দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না। ফিলিস্তিনী মুসলমান হত্যা করে ইসরাঈল তার রাষ্ট্র সীমা বাড়াতে সদা তৎপর। বিশ্ব মুসলিমের তাতে কিছু আসে যায় না। তারা একদম নির্বিকার। মিশরে এখন জেনারেল সিসি’র ধর্মনিরপেক্ষতা চলছে পুরোদমে। আর মুসলিম ব্রাদারহুড মার খেয়ে চলেছে। ইরাক, আফগানিস্তান একরূপ আমেরিকার দখলে। সুদানকে দু’ভাগ করে দিয়েছে। দ্বন্দ্ব চলছেই সেখানে। সিরিয়ারও তদবস্থা। লেবাননও তাই। লিবিয়া করতলে। অন্যান্য আরব দেশসমূহের অবস্থাও প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ের। কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে ইসলামের হাওয়া বইতে শুরু করায় সেখানেও দ্বন্দ্বের বীজ বুনন চলছে। পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র নামে কাংখিত ইন্দোনেশিয়াকে আধা হিন্দু রাষ্ট্র বলতে ক্ষতি নেই। সেদেশের লোকের নাম সুকর্ণ, সুহার্ত, মেঘবতী, কার্তিকেশ্বরী, রত্নেশ্বরী, সরশ্বতী ইত্যাদি। আবার তাদের ছোট প্রদেশ পূর্ব তিমুর স্বাধীন হয়ে খ্রীস্টান রাষ্ট্র বানিয়েছে, তা ঠেকাতে পারেনি। ষড়যন্ত্র চলছে পার্শ্বের দেশ মালয়েশিয়া নিয়েও। আমাদের বাংলাদেশের অবস্থাও শোচনীয়। স্কুল-কলেজের শিক্ষা সিলেবাসে ইসালামের গৌরব, ঐতিহ্যের কথা কিছু নেই। আছে রামায়ণ মহাভারতের গল্প। আছে আল্লাহ রাসূলকে না জানার কায়দা। জাত পাত সব বাদ দিয়ে মানব ধর্মের জয়গানের সুযোগ আছে। ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা যা আছে তাতে ছবি দেখা যায় মানুষের, যা ইসলামে নাজায়েয। নীতি শিক্ষাও সেই রকমের। কোনো নবী-রাসূল, ওলি-আউলিয়ার কাহিনী, চরিত্র জানার সুযোগ নেই। তাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কি শিখবে? শিখবে যে, মৌলবাদী মুসলমানরা সব জংগী। তারা জিহাদী বই রাখে এবং পড়ে। আসলে কুরআন পাকে জিহাদের কথা আছে জিহাদ কাকে বলে তাও আছে। জিহাদ কখন কীভাবে করতে হয়, তাও লেখা আছে। কুরআন পাকে আল্লাহ ইরশাদ করেন, “আর আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে, কিন্তু সীমালংঘন করো না। কারণ, আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে ভালোবাসেন না”। (সূরা বাক্বারাহ- ১৯০)।
এখন আলীয়া মাদ্রাসায়ও ছবি টাংগানো হয় এবং নারী পুরুষের সহাবস্থান রয়েছে। অতএব, হে দ্বীনদার মুসলমানগণ! তোমরা যারা আল্লাহকে মানো, মহানবী (সা.)কে মানো, তোমরা যতো ফেরকাতেই বিভক্ত থাকো না কেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে এক হয়ে গিয়ে তাদেরকে বর্জন করো। তোমাদের আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত তৈল, গ্যাস, সোনা দিয়ে অস্ত্র কিনে ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করো না। যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে, যারা তোমাদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চায়। পারো তো দ্বীনদার মুসলমান এক হয়ে একটা মুসলিম জাতিসংঘ তৈরী করো। তোমাদের ফয়সালা তোমরা করো, সেখানে কাফিরদের ডেকে এনো না। হে আল্লাহ! মুমিন মুসলমানদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। নইলে ইসলামের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবার আশংকা। একমাত্র রক্ষাকর্তা আল্লাহ। আমীন॥ #
[লেখকের ‘জন্মগতভাবে সকল মানুষ এক আচরণে ভিন্ন’-এর তৃতীয় কিস্তি]